
ছবি: জনকণ্ঠ
আজ ২৮শে জুন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন। এই দিনটি কেবল একজন নোবেল বিজয়ীর ব্যক্তিগত উদযাপনের উপলক্ষ নয়, বরং এটি একটি দর্শন ও সম্ভাবনার দিকে নতুন করে ফিরে তাকানোর দিন। এমন এক সময়ে তার জন্মদিন এসেছে, যখন তিনি দেশের ইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। তাই আজকের এই দিনে তার জীবন ও কর্মকে মূল্যায়ন করা কেবল অতীতচারিতা নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা খোঁজার একটি প্রচেষ্টা।
ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় অবদান নিছক একটি আর্থিক মডেলে সীমাবদ্ধ নয়, এর মূলে রয়েছে মানুষের মর্যাদার প্রতি গভীর বিশ্বাস। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর তিনি যখন দেখলেন যে প্রচলিত অর্থনীতি প্রান্তিক মানুষের নাগালের বাইরে, তখন তিনি এক যুগান্তকারী ধারণা নিয়ে এগিয়ে আসেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, দরিদ্র মানুষকে ঋণ দেওয়ার জন্য জামানতের প্রয়োজন নেই, তাদের সততা ও কর্মনিষ্ঠাই সবচেয়ে বড় জামানত। এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় গ্রামীণ ব্যাংক, যা শুধু একটি ব্যাংক নয় ররং, এটি ছিল মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়ার একটি আন্দোলন। তার এই ক্ষুদ্রঋণ ধারণা প্রমাণ করেছে যে, সুযোগ পেলে সাধারণ মানুষও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে এবং নিজের ভাগ্য নিজেই পরিবর্তন করতে পারে।
তার দর্শন ক্ষুদ্রঋণেই থেমে থাকেনি। তিনি বিশ্বকে ‘সামাজিক ব্যবসা’র এক নতুন ধারণা উপহার দিয়েছেন, যেখানে মুনাফা নয়, মানুষের কল্যাণই মূল লক্ষ্য। এই মডেলে ব্যবসার সকল শক্তিকে ব্যবহার করা হয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও পরিবেশের মতো জটিল সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য। এটি এমন এক পথ, যা পুঁজিবাদের কঠোরতা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সীমাবদ্ধতার মাঝে এক মানবিক ভারসাম্য তৈরি করে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’-তে আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, তার এই ধারণা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এবং আজকের পৃথিবীর সংকট মোকাবেলায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূস যখন দেশের হাল ধরেন, তখন অনেকেই সন্দিহান ছিলেন যে একজন অর্থনীতিবিদ কীভাবে রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করবেন। কিন্তু তিনি তার নেতৃত্ব ও কর্মে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনা কেবল রাজনৈতিক কৌশলের বিষয় নয়, এটি নীতি ও আদর্শেরও বিষয়। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তার নেওয়া উদ্যোগগুলো, যেমন—সারাদেশে নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে স্টারলিংকের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি চূড়ান্ত করার পদক্ষেপ কিংবা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল অর্থনীতি এবং জলবায়ু-সহনশীল সবুজ অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিজ্ঞা, তার দীর্ঘদিনের দর্শনেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি শুধু স্থিতিশীলতা ফেরাতে চান না, বরং এমন একটি ভিত্তি তৈরি করতে চান যেখানে প্রযুক্তি ও প্রকৃতি মানুষের কল্যাণে একযোগে কাজ করবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ড. ইউনূস বাংলাদেশের জন্য এক ইতিবাচক বার্তা বয়ে এনেছেন। সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছ থেকে পাওয়া ‘হারমোনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ তার জীবনব্যাপী শান্তি, স্থায়িত্ব এবং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সম্প্রীতি তৈরির প্রচেষ্টার এক বৈশ্বিক স্বীকৃতি। এই সম্মান শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি বাংলাদেশের জন্যও এক বিরাট গৌরব। এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ এখন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল নয়, মানবিক ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিশ্বকে পথ দেখাতে পারে।
ড. ইউনূসের ‘তিন শূন্য’র পৃথিবী—অর্থাৎ শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ—আজ আর কোনো তাত্ত্বিক ধারণা নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা হতে পারে। এই দর্শনকে সামনে রেখে যদি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নীতি সাজানো যায়, তবে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে বিভেদের রাজনীতির বদলে থাকবে সহযোগিতার সংস্কৃতি।
আজকের এই বিশেষ দিনে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় অর্জন কোনো পদ বা পুরস্কার নয়, তার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো মানুষের সম্ভাবনার ওপর আস্থা রাখার সাহস যোগানো। তার জীবন আমাদের শেখায় যে, সদিচ্ছা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে যেকোনো সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। তার জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হলো, তার দেখানো পথে হেঁটে একটি মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা।
শহীদ