
ছবি: জনকণ্ঠ
মাটির তৈরি মৃৎশিল্পের একসময় সারা দেশে ব্যাপক চাহিদা ছিল। এখন আর নেই সেই কদর। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায়ও এক সময় মাটির হাঁড়ি-পাতিল, প্রদীপ, সানকি এবং নানা রকম খেলনা ছিল কয়েকটি গ্রামের কুমার সম্প্রদায়ের প্রধান জীবিকার উৎস।
এই সম্প্রদায়ের প্রায় দুই থেকে তিন শতাধিক পরিবার দীর্ঘদিন ধরে এই শিল্পের মাধ্যমে সংসার চালাতো। তাদের সূক্ষ্ম হাতের তৈরি জিনিসপত্র স্থানীয় বাজার থেকে শুরু করে দূরবর্তী শহরেও চাহিদাসম্পন্ন ছিল। কিন্তু আজ সেই মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে, হারিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ এক সাংস্কৃতিক নিদর্শন।
তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী, আলমপুর, হাঁড়িয়ারকুটি ও সয়ার ইউনিয়নে এক সময় মাটির পণ্য তৈরি ছিল প্রসিদ্ধ কারুশিল্প। ঘরে বসেই মাটি চূর্ণ করে, জল মিশিয়ে কুমারের চাকা ঘুরিয়ে তৈরি হতো হাঁড়ি, পাতিল, সানকি, প্রদীপ ও খেলনা।
উপজেলার কাশিয়াবাড়ীর কুমার সম্প্রদায়ের প্রবীণ শিল্পী ধীরেন পাল বলেন, “ছোটবেলায় বাবা ও কাকার সঙ্গে বসে মাটির হাঁড়ি বানাতাম। তখন এর প্রচুর চাহিদা ছিল। গ্রামীণ মেলায় অনেক বিক্রি হতো। এখন আর সেই অবস্থা নেই। প্লাস্টিক ও মেলামাইনের পণ্যে বাজার ভরে গেছে।”
তিনি আরও জানান, এখন আঠালো মাটি কিনে আনতে হয়, কাঠ-খড়ের দাম অনেক বেড়ে গেছে, অথচ বিক্রিও কম। এ অবস্থায় অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। অন্য এক কারিগর রতন পাল বলেন, “এই কাজ এখন আর লাভজনক নয়। প্রতিদিন খরচ বাড়ছে, ক্রেতা কমছে। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।”
তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন এলাকার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক মো. রেজাউল করিম নয়ামিয়া বলেন, “সরকারি ও এনজিও সহায়তায় প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ এবং নিয়মিত মেলার আয়োজন হলে এই শিল্প পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। মাটির শিল্প শুধু আয়ের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের শিকড়, ইতিহাস ও সংস্কৃতি। যত্ন না নিলে হারিয়ে যাবে।”
হাঁড়িয়ারকুটি ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ীর স্থানীয় শিক্ষক মোকছেদুল ইসলাম বলেন, “এক সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামে হাঁড়ির টুংটাং শব্দে প্রাণ ছিল। এখন আর তা নেই।”
তার মতে, “আধুনিক ডিজাইন, প্রযুক্তি ও অনলাইন বাজারের মাধ্যমে এই শিল্পকে আরও নান্দনিক ও লাভজনক করা সম্ভব। বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। মেলার আয়োজন ও কারিগরদের উৎসাহ দিলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।”
তিনি মনে করেন, এই শিল্পের সংকট সমাধান না হলে শুধু একটি পেশা নয়, উপজেলার লোকশিল্পের এক গৌরবময় অধ্যায় চিরতরে হারিয়ে যাবে।
শহীদ