ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

হার্ভার্ড বনাম ট্রাম্প

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শিক্ষা

নাফিউ সাজিদ জয়

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ১৯ জুন ২০২৫

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শিক্ষা

একটি রাজনৈতিক ঝড় বইছে যুক্তরাষ্ট্রে- যে ঝড়ে জড়িয়ে পড়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, দেশটির সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে এটি শুধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার আলোচিত সংঘাত নয়। এটি আরও গভীর একটি লড়াই। উচ্চশিক্ষা আদৌ মতপ্রকাশ, অনুসন্ধান ও সমালোচনামূলক চিন্তার স্থান হতে পারবে কিনা, নাকি এখন থেকে কেবল ক্ষমতার প্রতিধ্বনি বহন করবে- এটি তারই যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে, তা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্যও এক বড় সতর্কবার্তা। এটি মনে করিয়ে দেয় যে, নিয়ন্ত্রণ, সেন্সরশিপ, প্রতিবাদ দমন- এসব শুধু পাশ্চাত্যের সমস্যা নয়। আমরাও প্রায়ই এগুলোর মুখোমুখি হই। এই মুহূর্তটি এক আয়না, যেখানে শুধু মার্কিন কর্তৃত্ববাদ নয়, আমাদের নিজেদের ব্যর্থতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এক মার্কিন ফেডারেল বিচারক সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণাকে সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন, যার মাধ্যমে হার্ভার্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিচারক একে প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যা দেন। ট্রাম্প প্রশাসন জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত উপস্থাপন করে। কিন্তু হার্ভার্ড বলছে, এটি আসলে রাজনৈতিক প্রতিশোধ। কারণ তারা সরকারপ্রদত্ত চাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সংকটের শুরু ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে। হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে, তার বিরুদ্ধে আমেরিকার ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ শুরু করে। হার্ভার্ড ছিল প্রথম সারির প্রতিবাদীদের অন্যতম। প্রতিক্রিয়াও ছিল তীব্র। ডানপন্থি মিডিয়া, দাতারা, রাজনীতিকরা এই বিক্ষোভগুলোকে ‘ইহুদিবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে। এই বর্ণনা শুধু টিভি স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি রূপ নেয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর একটি পূর্ণমাত্রার রাজনৈতিক হামলায়। হার্ভার্ডের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে কংগ্রেসে হাজির হন। তাঁর বিবৃতি, যা ছিল এক ভারসাম্যপূর্ণ পথচলার চেষ্টা, তা-ই হয়ে ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে আগুন জ্বালানোর পাথেয়। তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন অ্যালান গারবার। ঠিক সেই সময়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন- ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। ফিরেই ট্রাম্প শুরু করেন ‘ডব্লিউওকেই বিশ্ববিদ্যালয় (ড়িশব ঁহরাবৎংরঃরবং)’ দমন অভিযান। তিনি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। ডিইআই (উঊও: ফরাবৎংরঃু, বয়ঁরঃু, ধহফ রহপষঁংরড়হ) প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেন। যে প্রতিষ্ঠানগুলো ‘লাইন’ মেনে চলেনি, তাদের ফেডারেল অর্থায়ন বন্ধ করে দেন। মার্চে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি সরকারের চাপ মেনে নেয়- নিরাপত্তা নজরদারি ও সরকারের অন্যায্য দাবি পুরনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু হার্ভার্ড তা করেনি।
এপ্রিল নাগাদ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে ‘সিভিল রাইটস ভায়োলেশন’-এর তদন্ত শুরু করে। অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ইহুদিবিরোধিতার অভিযোগ। তাদের দাবি ছিল- ডিইআই (উঊও) প্রোগ্রাম বন্ধ করো, ‘অ্যান্টি-আমেরিকান’ হিসেবে চিহ্নিতদের নিষিদ্ধ করো, মধ্যপ্রাচ্য ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য হস্তান্তর করো। হার্ভার্ড এসব অস্বীকার করলে আগ্রাসন আরও তীব্র হয়। অনুদানে ভাটা পড়ে, নন-প্রফিট স্ট্যাটাস বাতিলের হুমকি আসে এবং সবচেয়ে নির্মম খড়গ নেমে আসে ২২ মে- হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি লাইসেন্স বাতিল করার মাধ্যমে। ফলে ৬,৭০০-এর বেশি শিক্ষার্থী, যা প্রায় হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশ; আইনি অনিশ্চয়তায় পড়ে। তাদের জীবন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়। ডিগ্রি প্রশ্নের মুখে পড়ে। তাদের একমাত্র অপরাধ? একটি প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করা, যারা রাজনৈতিক চাপে মাথা নত করেনি।
হার্ভার্ড মাথা নত করেনি। তারা সরকারকে আদালতে টেনে এনেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সাংবিধানিক ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে। একটি অস্থায়ী আদালতের আদেশ আপাতত শিক্ষার্থীদের দেশছাড়া হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু লড়াই এখানেই শেষ নয়। এখন হার্ভার্ড নিজের অর্থভাণ্ডার ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছে। শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং নাগরিক সমাজ একত্রিত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। এটি এখন আর কেবল একটি ক্যাম্পাসের ইস্যু নয়, বরং এটি প্রশ্ন তোলে। আদৌ কি বিশ্বে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিহিংসার শিকার না হয়ে, রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? এর ক্ষতি কিন্তু অপূরণীয় এবং দৃশ্যমান বাস্তব। গবেষণা বন্ধ হয়ে গেছে, ল্যাবগুলো অর্থ হারিয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ও প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্র ক্ষতির সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা; যারা প্রতি বছর আমেরিকার অর্থনীতিতে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখে, তারাও রাজনৈতিক দাবা খেলার গুটি হয়ে গেছে। একজন শিক্ষার্থীর কথায় তা-ই স্পষ্ট: ‘আমরা কেবল একটা ভূরাজনৈতিক দাবা খেলায় গুটি।’
হার্ভার্ডের মামলার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় যখন তারা ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। দুই দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের গবেষণা অনুদান মুক্ত করার দাবিতে তারা এই মামলাটি করে। বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ তোলে, ‘এই অনুদান আটকে দেওয়া অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং একাডেমিক স্বাধীনতার সরাসরি লঙ্ঘন। এই অনুদান গবেষণা, নিরাপত্তা, ক্যান্সার চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ’। কিন্তু এটি কেবল একটি মামলাই নয়, বরং এক বৃহত্তর আক্রমণের অংশ। ট্রাম্প প্রশাসন দ্রুত অনুদান কেটে দেয়, সিভিল রাইটস তদন্ত চালায় এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের চেষ্টা করে। একটি স্পষ্ট সংঘাত দেখা যায় হার্ভার্ড ল রিভিউ ঘিরে, যেখানে এক প্রাক্তন সম্পাদক, যিনি বর্তমানে ট্রাম্প উপদেষ্টা স্টিফেন মিলারের ঘনিষ্ঠ; তিনি জার্নালটির বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তোলেন। বিচার বিভাগে এই অভিযোগের আইনি ভিত্তি দুর্বল হলেও, বিষয়টিকে ফেডারেল তদন্তে রূপ দেওয়া হয়।
হার্ভার্ডের অভ্যন্তরীণ নথি থেকে জানা যায়, ওই ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কারণে, যা কোনো হুইসেলব্লোয়িং নয়। তবুও ট্রাম্পের দল হার্ভার্ডকে চাপ দেয় সেই শাস্তি প্রত্যাহার ও নথি মুছে ফেলতে। এটি কোনো জবাবদিহি নয়, এটি ছিল ভয় দেখানো। এই প্রেক্ষাপট এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করে যে, রাষ্ট্র যদি আইন ও অর্থনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করে আদর্শগত অনুগত্য আদায় করে, তাহলে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ কোথায়? প্রশাসনের দাবি ছিল- ডিইআই (উঊও) প্রোগ্রাম বাতিল করো, কারিকুলাম পরিবর্তন করো, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করো। সমালোচকদের মতে, এটি একাডেমিক মতপার্থক্য দমন ও অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনৈতিক অনুগত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের প্রচেষ্টা। সমর্থকেরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক আগে থেকেই বামঘেঁষা ও জবাবদিহিহীন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি হার্ভার্ডের মতো ৫৩ বিলিয়ন ডলারের তহবিলওয়ালা প্রতিষ্ঠানও মাথা নত করতে বাধ্য হয়, তাহলে বাকিরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? একজন প্রাক্তন ছাত্রের ভাষায়- ‘যদি হার্ভার্ডের সঙ্গে এমনটা হতে পারে, তাহলে দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই হতে পারে।’
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সরকারকে ‘না’ বলতে পারে কারণ তাদের নিজস্ব অর্থায়ন আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিকল্প অর্থায়নের উৎস খুঁজতে হবে- প্রাক্তন ছাত্রদের নেটওয়ার্ক, অংশীদারি, গবেষণা তহবিল ইত্যাদি। শুধু সরকারি অর্থে চলা মানেই অদৃশ্য শক্তিতে রাজনৈতিক শর্ত মেনে চলা। হার্ভার্ড নিখুঁত নয়, কিন্তু তারা বিপদের সময় নীরব থেকে যায়নি। এটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয়, বরং এমন স্থান যেখানে মানুষ মুক্তভাবে ভাবতে পারে, কঠিন প্রশ্ন তুলতে পারে এবং নতুন কল্পনা করতে পারে। 
নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসিতগুলো এখন এক কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে। আমরা কি ওপরের স্তরে সব কিছু ঠিকঠাক চলছে ভেবে নীরবতা বেছে নেব? নাকি সময় এসেছে সত্যিকার অর্থে স্বীকার করার- কিভাবে নীরবতা, ভয় ও রাজনৈতিক চাপ আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভিতর থেকে ক্ষয় করেছে? পরিবর্তন কেবল নেতৃত্ব বদলানোর মাধ্যমে আসবে না। দরকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধরনে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এবং একাডেমিক সংস্কৃতির গভীরে মৌলিক পরিবর্তন। যদি হার্ভার্ডও রাজনৈতিক দাবির চাপের মুখে পড়ে, তাহলে কম সম্পদ ও সুরক্ষা পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কেমন হবে? কতদিন আমরা নীরব ক্যাম্পাসকে স্থিতিশীল ভাবতে থাকব? সত্যি কথা হলো, হয়তো ট্রাম্প ও হার্ভার্ড কিছু সমঝোতায় পৌঁছাবে। কিন্তু এই টানাপোড়েনের মধ্যেও উভয় পক্ষ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। এ থেকেও আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি এমন আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়? আর কতদিন আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ বলে চালিয়ে যাব, যখন বাস্তবে তা নয়? যদি আমরা সত্যিই উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি, তাহলে সংস্কারে আরও বিলম্ব সহ্য করা যাবে না।

লেখক : গবেষক
[email protected]

প্যানেল

×