ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইকোট্যুরিজমে টেকসই সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সুন্দরবন

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ১২:৩১, ১৪ জুন ২০২৫

ইকোট্যুরিজমে টেকসই সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সুন্দরবন

ছ‌বি: সংগৃহীত

সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। কিন্তু এই বনভূমি শুধুমাত্র পরিবেশগত বা জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনা, বিশেষ করে ইকোট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটনের ক্ষেত্রে। বর্তমান বিশ্বে টেকসই উন্নয়নের ধারণা অনুযায়ী, সুন্দরবনের মতো অঞ্চলগুলোকে সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

ইকোট্যুরিজম এমন একধরনের পর্যটন, যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা বাড়ে, কিন্তু সেই পরিবেশের ক্ষতি হয় না, বরং রক্ষার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। Iqbal & Mozahid (2022)-এর গবেষণায় দেখা যায়, সুন্দরবনে ইকোট্যুরিজমের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও স্থানীয় জনগণের জীবিকা উন্নয়নের এক বাস্তব ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব। একইসাথে এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার। এখানে রয়েছে প্রায় ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪৫০+ প্রজাতির প্রাণী ও পাখি, পাশাপাশি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেন, যার মধ্যে ৯৫% দেশীয়। এই প্রবণতা পর্যটনের নতুন সুযোগ তৈরি করলেও, Jamal et al. (2022) দেখিয়েছেন অব্যবস্থাপনা, নীতিহীনতা এবং জনসম্পৃক্ততার অভাব এই প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে পারছে না।

পর্যটকরা যদি সঠিকভাবে গাইডেড ন্যাচার ট্রেইল, ওয়াইল্ডলাইফ ওয়াচিং, নদীপথে নৌভ্রমণ ইত্যাদি করেন, তবে তারা সরাসরি প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি সচেতন হবেন। এই সচেতনতা পরিবেশগত রক্ষায় সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ায়।

স্থানীয় মধু সংগ্রাহক, গাইড, নৌচালক, হোমস্টে মালিকরা এই ট্যুরিজমে সরাসরি উপকৃত হন। Ghosh & Ghosh (2019)-এর গবেষণায় বলা হয়, সুন্দরবনে পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয়দের প্রতি বছর গড়ে ২০–৩০% আয় বাড়ানো সম্ভব।

ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রিক হস্তশিল্প, বুটিক, রান্না, ও পরিবেশন শিল্পে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও আয়বৈষম্য হ্রাস পায়। পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণহীন ভিড় প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে। টাইগার ট্র্যাকিং বা গভীর বনাঞ্চলে অবাধ গমন জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর।

নিরাপদ থাকার জায়গা, সুপথ্য ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার অভাব পর্যটকদের বিরক্ত করে। Islam & Rahman (2019)-এর মতে, পর্যটনকেন্দ্রিক নীতিমালা না থাকলে পুরো অঞ্চল ক্ষতির মুখে পড়ে। প্লাস্টিক, বোতল ও নৌযান থেকে নির্গত তেল জলজ পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে। সুন্দরবনের নদী, খাল ও জোয়ার-ভাটার গতিপথ দূষিত হয়ে পড়ছে। পর্যটন গাইড, পরিবেশবিদ, কিংবা হোস্টেল পরিচালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর সংখ্যা নগণ্য।

সুন্দরবনের ইকোট্যুরিজম ব্যবস্থাকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজন কিছু বাস্তবভিত্তিক ও সুসংগঠিত নীতিগত পদক্ষেপ। প্রথমত, পর্যটকের সংখ্যা সীমিত রাখা ও নির্দিষ্ট পর্যটন করিডোর চিহ্নিত করা জরুরি। এটি বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গাইড, নৌচালক ও হোমস্টে পরিচালকদের প্রশিক্ষণ ও আনুষ্ঠানিক সনদ প্রদান করা উচিত। এতে তাদের দক্ষতা যেমন বাড়বে, তেমনি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সন্তুষ্টি নিশ্চিত হবে। তৃতীয়ত, সুন্দরবনের কাছাকাছি এলাকায় পরিবেশবান্ধব ইকো-রিসোর্ট স্থাপন এবং সেগুলোর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পর্যটনের মান উন্নত করা যাবে। চতুর্থত, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অভিযোজনভিত্তিক ট্যুর প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে, যাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়েও পর্যটনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। অবশেষে, আধুনিক বিশ্বে ইকোট্যুরিজম প্রসারে ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েবসাইট, ও অনলাইন বুকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক পর্যটকেরা আগ্রহী হন ও আস্থা অর্জন করেন।

এই পাঁচটি কৌশল যদি সম্মিলিতভাবে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায়, তবে সুন্দরবন কেবল একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে নয়, বরং একটি পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের মডেল হিসেবে গড়ে উঠবে।

Iqbal & Mozahid (2022)-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, ইকোট্যুরিজম কেবল অর্থনীতির উপাদান নয়, এটি একটি “conservation incentive”, অর্থাৎ পরিবেশ সংরক্ষণের অনুপ্রেরণা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৮, ১২ এবং ১৫ পূরণে সুন্দরবনের ইকোট্যুরিজম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন সরকারি পর্যায়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়, বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহ, এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

সুন্দরবন কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য এক প্রতীকী ও সম্ভাবনাময় ভিত্তি। ইকোট্যুরিজমের মাধ্যমে এই বনভূমিকে শুধু দর্শনীয় স্থান হিসেবে নয়, বরং টেকসই অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে রূপান্তর করা সম্ভব। গবেষণা প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, ও ব্যবস্থাপনায় সুন্দরবন হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মডেল ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আমাদের আজই এগিয়ে আসতে হবে প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।

লেখক: সুন্দরবন গবেষক (ইমেইল: [email protected])

এম.কে.

×