
অদৃশ্য এক শত্রুর নাম ডেঙ্গু। প্রতি বছর বর্ষা এলে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দেয় ডেঙ্গু জ্বর। এই ভাইরাসঘটিত রোগটি রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে মফস্বল, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো—ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দিনে কামড়ায়, এবং ঘরের ভেতরেই বেশি সক্রিয় থাকে। ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে, মৃত্যু ঘটছে শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষের। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের এখনই নিতে হবে কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
ডেঙ্গু ভাইরাস এবং এটা যেভাবে ছড়ায় :
ডেঙ্গু হলো ফ্ল্যাভিভিরিডি পরিবারের ভাইরাসজনিত একটি রোগ। এটি মূলত চার ধরনের ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়: DEN-1, DEN-2, DEN-3 ও DEN-4। এই ভাইরাসগুলো ডেঙ্গুর বাহক Aedes aegypti এবং Aedes albopictus মশার মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। একবার একজন মানুষ আক্রান্ত হলে তাকে কামড় দেওয়া মশা অন্যকে কামড় দিলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
এই মশাগুলো সাধারণত সকালে এবং সন্ধ্যায় বেশি কামড়ায়। বদ্ধ, পরিষ্কার পানিতে (যেমন—ফুলদানি, পরিত্যক্ত টায়ার, ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি, প্লাস্টিকের কন্টেইনার ইত্যাদি) তারা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে পরিণত মশায় পরিণত হয় এবং সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম হয়।
ডেঙ্গুর লক্ষণসমূহ :
- ডেঙ্গুর উপসর্গ সাধারণত ভাইরাস সংক্রমণের ৪–১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। কিছু সাধারণ উপসর্গ হলো:
- তীব্র জ্বর (১০২–১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত)
- মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা
- পেশি ও হাড়ে ব্যথা (তাই ডেঙ্গুকে ‘হাড়ভাঙা জ্বর’ও বলা হয়)
- গায়ে র্যাশ বা লালচে ফুসকুড়ি
- বমি ভাব, খাবারে অরুচি
- গা ম্যাজম্যাজে ভাব ও দুর্বলতা
তবে কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার দেখা দেয়, যেখানে রক্তক্ষরণ হতে পারে (নাক, মুখ, প্রস্রাব বা মল দিয়ে), প্লাটিলেট কমে যায়, রক্তচাপ হ্রাস পায় এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের করণীয় :
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা এবং ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হওয়া। নিচে প্রতিরোধমূলক করণীয়গুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
পরিবেশগত পদক্ষেপ :
১. বদ্ধ পানি জমতে না দেওয়া: সপ্তাহে অন্তত একবার ফুলদানি, টব, এসির নিচে পাত্র, ফ্রিজের ট্রে ইত্যাদি পরিষ্কার করা।
২. পরিত্যক্ত জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা: ব্যবহৃত টায়ার, বোতল, নারকেলের খোসা, ভাঙা ড্রাম—এসব কিছু বৃষ্টি হলে পানি জমে যায়।
৩. বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা: ঝোপঝাড়, ঘন আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে রাখা জরুরি।
৪. নালা-নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার: যাতে পানি জমে না থাকে ও মশা জন্মাতে না পারে।
৫. মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত ও ধ্বংস করতে স্থানীয় সরকারকে সহায়তা করা।
ব্যক্তিগত সুরক্ষার ব্যবস্থা :
১. হাত-পা ঢাকা কাপড় পরা, বিশেষ করে সকাল ও বিকেলে।
২. দিনেও মশারি ব্যবহার করা, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য।
৩. মশা নিরোধক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার।
৪. বাড়ির জানালায় জালি বসানো ও মশা ঢোকার পথ বন্ধ রাখা।
৫. প্রাকৃতিক তেল যেমন ইউক্যালিপটাস বা লেমন গ্রাস তেল ব্যবহার।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে যা করবেন :
১. নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া যাবে না, বরং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
২. প্যারাসিটামল ব্যতীত অন্য কোনো ব্যথানাশক (যেমন অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন) গ্রহণ করা যাবে না—এগুলো রক্তপাত ঘটাতে পারে।
৩. প্রচুর তরল পানীয়, যেমন: ওরস্যালাইন, ডাবের পানি, লেবু পানি খেতে হবে।
৪. নিয়মিত প্লাটিলেট গুণে চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
৫. জ্বর কমে গেলেও শারীরিক দুর্বলতা ও সতর্কতা বজায় রাখা জরুরি।
সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে প্রতিটি ঘরে :
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সচেতনতা। পরিবার, স্কুল, অফিস, বাজার, মসজিদ—সবখানে সচেতনতামূলক বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। টিভি, রেডিও, ইউটিউব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিতভাবে প্রচারণা চালাতে হবে।
কিছু জরুরি প্রচারণা উদ্যোগ :
- স্কুল-কলেজে ডেঙ্গুবিষয়ক কুইজ ও সেমিনার
- মসজিদে জুমার খুতবার সময় স্বাস্থ্যবিষয়ক বার্তা
- স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা অভিযান
- স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর ‘কমিউনিটি ক্লিনিং ডে’
রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা :
- সরকারের স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে:
- সিটি করপোরেশন/পৌরসভার অধীনে নিয়মিত ফগিং ও ওষুধ ছিটানো
- মশার বংশ ধ্বংসে আধুনিক বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল পদ্ধতি প্রয়োগ
- হাসপাতানে পর্যাপ্ত বিছানা, রক্ত পরীক্ষার কিট, চিকিৎসক ও নার্স নিশ্চিত করা
- ডেঙ্গু ডেটাবেইজ তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা
একসাথে লড়াই করলেই ডেঙ্গু পরাজিত হবে :
ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত সচেতনতা, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা এবং প্রশাসনিক সক্রিয়তা। আমরা যদি নিজের পরিবার, পাড়া, বিদ্যালয়, কর্মস্থল পরিচ্ছন্ন রাখি এবং সচেতন হই—তাহলে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক কমানো সম্ভব। একা কেউ এটা মোকাবিলা করতে পারবে না, কিন্তু সকলে মিলে পারবই। সচেতন হই, পরিচ্ছন্ন থাকি, ডেঙ্গু রুখে দাঁড়াই।
আঁখি