
"একটি শিশুর হাতে যখন কুরআন থাকে, তখন তার হৃদয়ে থাকে আলোর ঝর্ণা। মক্তব সেই আলোর পথচলা শুরু করার প্রথম ধাপ।" মক্তব—শুধু একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র নয়, এটি মুসলিম সমাজে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চরিত্র গঠনের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে এসেছে। এটি এমন এক প্রতিষ্ঠান, যেখানে শিশুদের হৃদয়ে ইসলামের আলো প্রবেশ করে এবং তারা আদব-কায়দা, নামাজ, ওজু, কুরআন তেলাওয়াত ও ইসলামী ইতিহাসের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে।
একজন শিশুর জীবন গঠনের সূচনালগ্নেই যদি নৈতিকতা, দয়া, সহানুভূতি, শিষ্টাচার এবং আল্লাহভীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সেই শিশু ভবিষ্যতে শুধু একজন ভালো মুসলমানই নয়, সমাজের জন্য একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবেও গড়ে ওঠে। মক্তব এই নৈতিক ভিত্তি তৈরির সূতিকাগার। এটি কেবল ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের স্থান নয়, বরং একটি "নৈতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র"—যেখানে শিশুর মনন গঠিত হয় পরমতসহিষ্ণুতা, ন্যায়বোধ ও মানবিকতার আলোকে।
মক্তবে সাধারণত যেসব বিষয় শেখানো হয় তার মধ্যে রয়েছে: কুরআন শিক্ষা (নূরানী পদ্ধতি বা তাজভিদ সহ), নামাজ শিক্ষা, ওজু ও তাহারাত সংক্রান্ত বিধান, ছোট ছোট দোয়া ও সূরা মুখস্থ, আখলাক ও আদব এবং নবী-রাসূলদের ইতিহাস। এগুলো শিশুর চিন্তা-চেতনা ও আচরণে এক স্থায়ী প্রভাব রাখে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার, পশ্চিমা ভাবধারার প্রভাব এবং ধর্মীয় উদাসীনতার ফলে মক্তব আজ অনেক এলাকায় গুরুত্ব হারাচ্ছে। সমাজের একটি অংশ মনে করছে যে ধর্মীয় শিক্ষা শুধুমাত্র মসজিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যা একধরনের বিভ্রান্তিকর ধারণা। এর ফলে অনেক শিশু আর মক্তব পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না, এবং এই শূন্যতা ভবিষ্যতে তাদের নৈতিক ও আত্মিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে।
ধর্মীয় শিক্ষার অভাব সমাজে মূল্যবোধহীনতা, নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধপ্রবণতা বাড়াচ্ছে। অথচ মক্তব থেকেই শিশুরা শেখে সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সমাজ ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ। ধর্মীয় শিক্ষাকে অবহেলা করে শুধু আধুনিকতা রপ্ত করে আমরা শিশুদের মন থেকে আদর্শ ও মূল্যবোধ মুছে ফেলছি।
আজ যখন দেখা যাচ্ছে যে কিছু জায়গায় মক্তবগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, অকার্যকর করে রাখা হচ্ছে বা অবহেলার শিকার হচ্ছে, তখন এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস নয়, বরং একটি সংস্কৃতি, একটি নৈতিক ব্যবস্থার অবলুপ্তি। এটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন মক্তবকে পুনর্জীবিত করা, সময়োপযোগী ও শিশুবান্ধব পাঠক্রম প্রবর্তন করা এবং আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা। ইসলাম ও নৈতিকতার শিক্ষা যদি ছোটবেলা থেকেই প্রদান করা হয়, তাহলে একটি মূল্যবোধসম্পন্ন, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত সমাজ গঠনের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব।
মক্তব আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের আত্মিক শক্তির উৎস। একে সংরক্ষণ করা শুধু অতীতের প্রতি দায়িত্ব নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রতি একটি প্রতিশ্রুতি।
আঁখি