ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চামড়া শিল্পে বিপর্যয় ও আশার আলো

নাফিউ সাজিদ জয়

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ১২ জুন ২০২৫

চামড়া শিল্পে বিপর্যয় ও আশার আলো

বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে দীর্ঘদিন ধরেই অমিত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এর কাক্সিক্ষত বিকাশ ঘটেনি। প্রতি বছর ৩৫ কোটিরও বেশি স্কয়ার ফিট কাঁচা চামড়া উৎপাদন হলেও এই বিপুল সম্পদ বৈশ্বিক চামড়া শিল্পের একটি কেন্দ্রে পরিণত করতে পারেনি। তৈরি পোশাক খাত যেভাবে নীতিগত সহায়তা ও আন্তর্জাতিক মান রক্ষার মাধ্যমে উন্নতি করেছে, তেমন রূপান্তর চামড়া শিল্পে দেখা যায়নি।

মূল সংকট : পরিবেশগত

চামড়া শিল্পের স্থবিরতার কেন্দ্রে রয়েছে পরিবেশগত অননুযায়িতা। ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারিগুলো স্থানান্তর করা হয়েছিল দূষণ কমানোর আশায়। কিন্তু বাস্তবে দূষণ শুধু স্থানান্তর হয়েছে, বন্ধ হয়নি। সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (CETP) এখনো সম্পূর্ণরূপে কার্যকর নয়। এটি দৈনিক মাত্র ২৫,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে, যেখানে চাহিদা ৪২০০০-৪৫,০০০ ঘনমিটার পর্যন্ত পৌঁছে যায় মৌসুম অনুযায়ী। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সিইটিপিতে (CETP) ক্রোমিয়াম ও লবণের মতো বিষাক্ত উপাদান পরিশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ইউনিটই নেই। ফলে অপরিশোধিত ক্রোমিয়ামে ভরা তরল বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ছে। আরও ভয়াবহ হলো কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা। ক্রোম শেভিং ডাস্ট ও অন্যান্য আবর্জনা খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে, যা মাটি, ভূগর্ভস্থ পানি এবং খাদ্যচক্রকে দূষিত করছে। এই বিষাক্ত বর্জ্য মাছ ও পোল্ট্রির খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলতে থাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে। এই অননুযায়িতা কেবল পরিবেশ নয়, অর্থনীতিকেও আঘাত করছে। অধিকাংশ ট্যানারি আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (Leather Working Group- LWG) সনদ পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই সনদে মোট ১৭১০ পয়েন্টের মধ্যে ১৫০ পয়েন্ট শুধু কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়, যেখানে বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোর দুর্বলতা স্পষ্ট।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (BSCIC) সম্প্রতি এই ক্ষেত্রে চারটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে-১. সিইটিপির (CETP) অসম্পূর্ণ পরিকাঠামো, ২. ট্যানারি মালিকদের অনীহা ও দায়িত্বহীনতা, ৩. দুর্বল কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ৪. অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশ ইত্যাদি। এই শিল্পের ৭০ শতাংশের বেশি শ্রমিক রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। অধিকাংশের নেই কোনো লিখিত চুক্তি, নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী, আর মজুরি এমন যে জীবনধারণই কঠিন। এই কাঠামোগত সমস্যাগুলো দূর না করলে শিল্পের স্থায়ী বিকাশ সম্ভব নয়।

চীনা বিনিয়োগে বর্জ্য পুনর্ব্যবহার

এই অন্ধকার সময়ে এক চীনা উদ্যোগ সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ জেড ডব্লিউ অ্যানিমেল প্রোটিন কো. লিমিটেড (ZW Animal Protein Co. Ltd.)- চীনের ওয়েনঝু ইউয়ানফেই ও উত্তর কোরিয়াভিত্তিক পিয়ংইয়াং বিনিয়োগকারীদের একটি যৌথ প্রকল্প, যা সাভারের ট্যানারি বর্জ্য থেকে জেলাটিন ও শিল্পজাত প্রোটিন পাউডার তৈরি করছে। নয় একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কারখানাটির রয়েছে নিজস্ব ইটিপি। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসটেট ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের (Dhaka Tannery Industrial Estate Waste Treatment Plant Company Ltd.) সঙ্গে ক্রোম শেভিং ডাস্ট সংগ্রহের চুক্তি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা পারভেজ খান জানান, তারা প্রতি বছর প্রায় ৫,০০০ টন জেলাটিন ও প্রোটিন পাউডার চীন ও রাশিয়ায় রপ্তানির পরিকল্পনা করছেন। ওয়েট ব্লু চামড়া থেকে তৈরি জেলাটিন মূলত ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে ক্যাপসুল শেলের উপাদান হিসেবে। অপরদিকে প্রোটিন পাউডার ক্রোমযুক্ত বর্জ্য থেকে তৈরি হওয়ায় এটি আবার চামড়া কোমল করতে ব্যবহৃত হয়, যা প্রচলিত বিপজ্জনক পদ্ধতির চেয়ে অনেক নিরাপদ ও টেকসই।
সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা অবৈধ বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করছে- যেখানে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য প্রাণিখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নতুন এই উদ্যোগ সেই চক্র ভেঙে, বর্জ্যকে রপ্তানিযোগ্য সম্পদে পরিণত করছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট (waste management) কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘একসময় যেসব বর্জ্য পরিবেশের জন্য হুমকি ছিল, এখন তা রপ্তানিযোগ্য পণ্যে রূপ নিচ্ছে। এলডব্লিউজি (LWG) সনদের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারে।’

নিরাপদ ল্যান্ডফিল প্রকল্প

ব্যক্তি খাতে এই উদ্ভাবনের পাশাপাশি সরকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্লাইমেট ট্রাস্ট ফান্ড (Climate Change Trust Fund) থেকে ১০ কোটি টাকার একটি নিরাপদ ল্যান্ডফিল প্রকল্প অনুমোদন পায়। ২০২৫ সালের মধ্যে বিএসসিআইসি (BSCIC) কর্তৃক বাস্তবায়নযোগ্য এই ল্যান্ডফিলে থাকছে বহুস্তরবিশিষ্ট সুরক্ষা কাঠামো, যাতে ক্রোমযুক্ত লিচেট ভূগর্ভে যেতে না পারে। সব তরল বর্জ্য সিইটিপি CETP-এর মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে নদীতে প্রবাহিত হবে। বিএসসিআইসির (BSCIC) পরিকল্পনা ও গবেষণা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ড. মো. ফারহাদ আহমেদ বলেন, ‘এই ল্যান্ডফিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নদী দূষণ কমানোর পাশাপাশি ট্যানারিগুলোকে এলডব্লিউজি (LWG) সনদের ১৫০ পয়েন্ট অর্জনে সহায়তা করবে।’

জাতীয় পর্যায়ে পরিবেশ বিপর্যয়

তবে সমস্যা দূষণ শুধু সাভারেই সীমাবদ্ধ নয়। চামড়া ও অন্যান্য শিল্প বর্জ্য দেশের অন্তত ১৪টি প্রধান নদীকে দূষিত করছে- এর মধ্যে রয়েছে: বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, ভৈরব, রূপসা ও কর্ণফুলী। বুড়িগঙ্গা আজও দখল ও দূষণের প্রতীক। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরালেও, গাজীপুর ও টঙ্গীর নানা অবৈধ কার্যক্রম থেকে বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। ফলে মৎস্যসম্পদ হ্রাস, পানির অযোগ্যতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবহান বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে চামড়া বর্জ্যরে কারণে তিন দশকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এটা শুধু পানির ক্ষতির হিসাব। জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির কোনো পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো আমাদের হাতে নেই।’

কোরবানি ঈদ ও বার্ষিক দূষণ

প্রতি বছর কোরবানি ঈদের সময় চামড়া শিল্প আবার আলোচনায় আসে। কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় কেটে গেলেও সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। ঈদের সময় সিইটিপি অচল থাকায় অনেক কারখানা অকার্যকর হয়ে যায়। প্রক্রিয়াজাত চামড়া রাস্তার ধারে ফেলে দেওয়া হয়, যেগুলো পরে ড্রেন ও খাল হয়ে ধলেশ্বরীতে গিয়ে মেশে। সরকারি হিসাবে, হেমায়েতপুরে প্রতিদিন গড়ে ২০,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য ও ১২০ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। ঈদের সময় তা বেড়ে ২৫০ টনের বেশি হয়। বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও গোপন স্বার্থ ও অদৃশ্য বাধার কারণে প্রকৃত উন্নয়ন থমকে থাকে। সম্প্রতি পরিবেশ ফান্ডের মাধ্যমে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদি এটি কার্যকর হয়, তবে বহুল প্রতীক্ষিত পরিবর্তনের দরজা খুলে যেতে পারে। কারণ বৈদেশিক ক্রেতারা এখন পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। যদি তা নিশ্চিত না হয়, তবে অর্ডার চলে যেতে থাকবে ভারত, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে, যারা পরিবেশ নিয়ে আরও দায়িত্বশীল।

প্রতিবেশী থেকে শিক্ষা নেওয়া

বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এখন এক সন্ধিক্ষণে। বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনা, দুর্বল তদারকি ও অননুযায়িতা শুধু পরিবেশকেই ধ্বংস করেনি, বরং বৈশ্বিক বাজারে আমাদের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও জেডডব্লিউ অ্যানিমেল প্রোটিনের (ZW Animal Protein) মতো উদ্যোগ ও সরকারের ল্যান্ডফিল প্রকল্প একটি বিরল সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন কাঠামোগত, সমন্বিত সংস্কার, যার মধ্যে থাকবে: সিইটিপি (CETP) সম্পূর্ণরূপে কার্যকর ও উন্নত করা, যাতে ক্রোম, লবণসহ অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান পরিশোধন সম্ভব হয়। সকল ট্যানারিতে পরিবেশ ও শ্রম আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, শুধু ঈদের সময় নয়, সারা বছরব্যাপী। স্বাধীন ও স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গঠন, যাতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা।
এই সংস্কারগুলো যদি আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প টেকসই কর্মসংস্থান, নৈতিক বাণিজ্য ও সবুজ শিল্পায়নের উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। না হলে সব আশাব্যঞ্জক উদ্যোগই শুধু পরিত্যক্ত সম্ভাবনার ইতিহাস হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের জন্য মূল শিক্ষা

১. প্রযুক্তিনির্ভর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ। ২. সার্কুলার ইকোনমি-ভিত্তিক শিল্প উদ্ভাবনে সহায়তা। ৩. বাজার-ভিত্তিক প্রণোদনার মাধ্যমে পরিবেশ সম্মত উৎপাদনে উৎসাহ। ৪. মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন ও বা¯তবায়ন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পরিবর্তনের জানালা এখনো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। যদি এখনই উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে চামড়া শিল্প হতে পারে বাংলাদেশের টেকসই শিল্পায়নের নতুন দিগন্ত।


লেখক : গবেষক
[email protected]

প্যানেল

×