
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের এক কোণে, যেখানে একসময় তাঁতের ছন্দময় শব্দ প্রতিধ্বনিত হতো নদীপাড় ও মেঠোপথ জুড়ে, সেখানে আজ নীরবতা নেমে এসেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই হস্তচালিত তাঁতশিল্প বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। অথচ আজ এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প এক গভীর সংকটে, শিল্পায়ন, অবহেলা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে তা ধ্বংসের পথে।
হারিয়ে যাচ্ছে গৌরবময় অতীত
হস্তচালিত তাঁত বলতে বোঝায় এমন যন্ত্র যা সম্পূর্ণ মানবশক্তিতে পরিচালিত হয়। বৈদ্যুতিক শক্তির ব্যবহার এখানে নেই। পা দিয়ে প্যাডেল চালিয়ে সুতা আলাদা করা এবং হাতে বুনন করার এই পদ্ধতি শারীরিক দক্ষতা ও শিল্পনৈপুণ্যের এক নিখুঁত মিলন। কাঠ ও লোহার তৈরি এই তাঁত শুধু যন্ত্র নয়। এটি জাতির ধৈর্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতীক।
১৯৯০ সালে দেশে ২ লাখ ১২ হাজার ৪২১টি চালু তাঁত থাকলেও ২০১৮ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ লাখ ১৬ হাজারে। অর্থাৎ তিন দশকে প্রায় ৪৫% কমে গেছে। তাঁতির সংখ্যা একসময় ১০ লাখের অধিক থাকলেও, বর্তমানে তা তিন লাখে এসে ঠেকেছে। দ্রুত উৎপাদন এবং সুবিধার কারণে হস্তচালিত তাঁত শিল্পের জায়গা দখল করে নিচ্ছে পাওয়ারলুম। তবে পাওয়ারলুমে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়লেও এতে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পের সৌন্দর্য, মানবিকতা ও সাংস্কৃতিক সৃজনশীল স্বাক্ষর।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার একসময় তাঁতশিল্পের প্রাণকেন্দ্র ছিল। এখন সেখানে কয়েক হাজার তাঁতের মধ্যে চালু রয়েছে অল্প কিছু। তাতীপাড়া, শ্রীনিবাসদি, খিরদাসাদি, জঙ্গলিয়া- এসব গ্রামে একসময় তাঁতের শব্দে মুখর থাকত প্রতিটি সকাল-সন্ধ্যা। আজ সেখানে নিঃস্তব্ধতা। সুতা, রং ও রাসায়নিকের উচ্চমূল্যের ভার বইতে না পেরে অনেকেই তাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ গেছেন পাওয়ারলুম কারখানায়। আর কেউ কেউ- বিশেষত নারী ও প্রবীণ তাঁতিরা, হয়ে গেছেন কাজহীন ও উপেক্ষিত। নরসিংদীর শেখেরচরের বাবুরহাট মার্কেট কিংবা রামচন্দ্রদী গ্রামের কথা বললেও সেই একই চিত্র দেখা যায়।
তাঁত শিল্পীরা জীবন বোনে
শুধু কাপড় নয়
বাংলাদেশের বৃহত্তম কুটিরশিল্প হিসেবে তাঁতশিল্প কৃষির পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ সরাসরি এবং ৫ লাখের বেশি মানুষ পরোক্ষভাবে এই শিল্পে নিয়োজিত। তাঁতশিল্প বছরে প্রায় ৬২০ মিলিয়ন মিটার কাপড় উৎপাদন করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ মূল্যের অবদান রাখে। এই শিল্পের অর্ধেক কর্মীই নারী। তারা পরিবারের মধ্যে রং, সুতা প্রস্তুত ইত্যাদি কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তাদের শ্রম অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান কিংবা সামাজিক স্বীকৃতিতে জায়গা পায় না। এই অদৃশ্য শ্রম নারীদের অবমূল্যায়ন ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া থেকে তাদের বঞ্চিত রাখে।
গৌরবান্বিত তাঁতশিল্প আজ হুমকির পথে
বঙ্গদেশে তাঁতশিল্পের ইতিহাস বহু পুরানো। হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতা প্রমুখ পর্যটকরা এই অঞ্চলের কাপড় বননশৈলীর প্রশংসা করেছিলেন। ঢাকার মসলিন একসময় এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে তাকে ‘হাওয়ার চেয়েও পাতলা’ বলা হতো। ১৭৮৭ সালে এক বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মসলিন রপ্তানি হয়েছিল। উপনিবেশিক শোষণে এই শিল্প ভেঙে পড়লেও স্বাধীনতা-উত্তর কালে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুচ্ছি, নরসিংদী ইত্যাদি জেলায় তাঁতশিল্প পুনরায় গড়ে ওঠে। জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, রাজশাহীর সিল্ক, কুমিল্লার খাদি ও সিলেটের মণিপুরী তাঁত- এসব শুধু পোশাক নয়, বরং সংস্কৃতির বহনকারী প্রতীক। কিন্তু আজ এই শিল্প সংকটে। নির্মাণশিল্পের প্রসার ও লাভজনক পেশায় যাওয়ার লোভে বহু তাঁত শ্রমিক পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। তাঁত শিল্প কেন্দ্রিক অঞ্চলগুলোয় বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সরকারি প্রকল্পে বেশি মুনাফায় কাজের লোভে এ সকল সৃষ্টিশীল পেশায় জড়িত তাঁতশিল্পীরা তাদের পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন। যা তাঁতশিল্পের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা ও বাজারের সীমাবদ্ধতা তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজনকে হতাশ করছে এবং তারা ক্রমান্বয়ে লোকসানের অতল গহ্বরে পতিত হচ্ছেন। তবে, নেপাল ও ভুটানে সম্ভাব্য বাজার থাকলেও সেখানে পৌঁছাতে হলে দরকার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা।
সংকট ও নীতিগত বৈষম্য
পাওয়ারলুমের প্রসার ও সস্তা বিদেশী কাপড়ের আমদানি হস্তচালিত তাঁতের বাজার ভেঙে দিয়েছে। ক্ষুদ্র তাঁতিরা যখন উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম পান না, তখন তাঁদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। চীন ও ভারতের সিনথেটিক কাপড় বাজার ছেয়ে ফেলায় দেশীয় তাঁত পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। সুতা, রং, রাসায়নিকের দাম দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু ক্ষুদ্র তাঁতিরা পাইকারি বাজারে পৌঁছাতে না পারায় খুচরা দামে পণ্য কিনতে হয়। ফলে লাভ থাকে না। আবার সঠিক সময়ে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগও খুব সীমিত। ২০০৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া তাঁত ইউনিটগুলোর ৮০% মূল কারণ ছিল মূলধনের অভাব। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় তাঁতিরা আধুনিক ডিজাইন, মান নিয়ন্ত্রণ বা বাজার বিশ্লেষণ করতে পারেন না। এছাড়া, তাঁতপণ্যের জন্য নেই ব্র্যান্ডিং, জিআই (এও) ট্যাগ বা সনদ, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন তাঁতিরা। নীতিনির্ধারকরা যন্ত্রচালিত শিল্পের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। কর ছাড়, রপ্তানি প্রণোদনা বা বিনিয়োগ প্রকল্পে হাতচালিত তাঁতের অংশগ্রহণ প্রায় নেই বললেই চলে। যেসব প্রণোদনা আছে, তা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, আর বাস্তবে তা তাঁতিরা জানেন না বা পেতে পারেন না।
শ্রমিকদের দুর্দশা
প্রথাগত তাঁত শ্রমিকের মাসিক আয় গড়ে মাত্র ৪,৫৯০ টাকা। পাওয়ারলুম শ্রমিক পান ৭,২০০ টাকা। দুটোই জীবনধারণের জন্য অপ্রতুল। দৈনিক ৯-১২ ঘণ্টা কঠিন শারীরিক পরিশ্রম সত্ত্বেও তাঁতিরা রয়ে গেছেন বঞ্চিত। নারী ও প্রবীণ তাঁতিরা রয়েছেন আরও ঝুঁকিতে। তাদের শারীরিক সক্ষমতা কম থাকায় তাঁত চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করায় নেই বেতন, নিরাপত্তা বা সুরক্ষা। তাদের কাজের স্বীকৃতি নেই- যার কারণে নীতি-পরিকল্পনাতেও নেই তাদের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ।
বাংলাদেশের হস্তচালিত তাঁত শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য নিচের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন জরুরি
স্বল্পমূল্যের প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ : ছোট ও মাঝারি তাঁতিদের জন্য হালকা, পেডালচালিত বা উন্নত হস্তচালিত তাঁত সরবরাহে ভর্তুকি। ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ, সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং মৌসুমি উৎপাদনের আগে সহজে ঋণপ্রাপ্তির ব্যবস্থা।
কাঁচামালের ওপর কর হ্রাস ও নিয়ন্ত্রিত বাজার : সুতা, রং ও রাসায়নিকের ওপর শুল্ক বা কর হ্রাস। কৃষি খাতের মতো মূল্য স্থিতিশীলতা ব্যবস্থা চালু করা।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন : ডিজাইন উদ্ভাবন, গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার বিশ্লেষণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও বা বিদেশী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে প্রশিক্ষণ। সমসাময়িক ফ্যাশনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল শেখানো।
বাজার ও রপ্তানি আধুনিকায়ন : সরকারি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, দেশি-বিদেশি ট্রেড ফেয়ার ও ব্র্যান্ডিং প্রচারণা। জিআই (GI) ট্যাগ ও গুণগত সনদ প্রদান। ভারত, ভুটান ও নেপালের মতো বাজারে রপ্তানির সুযোগ তৈরিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি।
হস্তচালিত তাঁত রপ্তানি অঞ্চল গঠন : কর অব্যাহতি, লজিস্টিক সহায়তা ও ইনসেন্টিভ-সমৃদ্ধ বিশেষ রপ্তানি অঞ্চল স্থাপন।
সমবায় শক্তিশালীকরণ : পেশাদার ব্যবস্থাপনায় ও গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত সমবায় গঠন। সমবায় নেতাদের আধুনিক ব্যবসায়িক জ্ঞান দিয়ে প্রশিক্ষণ। নীতিনির্ধারণী আলোচনায় সমবায় প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তি।
নারীর অংশগ্রহণ ও স্বীকৃতি : নারীদের কাজের আনুষ্ঠানিক নথিভুক্তি ও প্রশিক্ষণ সুবিধা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নেতৃত্বে নারীর অন্তর্ভুক্তি। পরিবারভিত্তিক তাঁতখাতে নারীর অবদানকে অর্থনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা : বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও সড়ক উন্নয়ন। তাঁত শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রবর্তন।
বাংলাদেশের তাঁতশিল্প বিশেষ করে হস্তচালিত তাঁতখাত- শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়। এটি জাতির ইতিহাস, সহনশীলতা ও পরিচয়ের জীবন্ত ও প্রাণবান ভান্ডার। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ নারীদের না-বলা গল্প, বিলীনপ্রায় কারিগরদের স্মৃতি, এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের সম্মিলিত গর্ব। তবে সময়োচিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুসংগঠিত সহায়তা ছাড়া এই ঐতিহ্য একদিন চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। তাই এই শিল্পকে রক্ষা করা মানে শুধু একটি কারুশিল্পকে টিকিয়ে রাখা নয়, বরং এমন এক সভ্যতাকে সম্মান জানানো, যা যুগে যুগে আপন আত্মাকে বুনে নিয়েছে সুতায়। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায়, ‘একটি জাতির সংস্কৃতি তার মানুষের হৃদয়ে ও হাতে বাস করে।
লেখক : গবেষক
প্যানেল