ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য আর কত দিন!

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:২৬, ১৬ মে ২০২৫

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য আর কত দিন!

বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশবাসী চলমান কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতা নিয়ে সম্যক অবগত। দেশের নগর-শহরসহ তৃণমূল পর্যায়ে এদের ভয়ংকর কর্মকাণ্ড সমগ্র জনগণের হৃদয়ে শুধু গভীর আতঙ্ক তৈরি করছে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পদচারণা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে তা নিয়ে তারা দারুণ যন্ত্রণাদগ্ধ। জনশ্রুতি মতে, প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলে অত্যন্ত পরিচিত ‘বড় ভাই’ নামধারী পৃষ্ঠপোষকদের সার্বিক অনুপ্রেরণা-সহযোগিতায় এদের চরম বেপরোয়া হওয়ার বিষয়টি সর্বত্রই প্রকাশ্যে। প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যম-ইলেকট্রনিক সম্প্রচার-সামাজিক যোগাযোগ-অনলাইনভিত্তিক ইউটিউবসহ সকল ধরনের প্রচারে এতসব ভয়ানক দৃশ্যপট উপস্থাপিত হচ্ছে, তাতে মনে হয় মানবিক সমাজের পঙ্গুত্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছোনোর তেমন অবশিষ্ট নেই। কমবয়সী-অপ্রাপ্ত-অবুঝ শিশু-কিশোরদের জীবন বিধ্বংসী মাদক-অস্ত্র-অসামাজিক কর্মযজ্ঞ পুরো দেশকে বিপন্ন করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নানা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এদের নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা-আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপরতার কার্যকারিতা তেমন ফলপ্রসূ নয়। তল্লাশি, গ্রেপ্তার অভিযানসহ নানা পদক্ষেপেও কিশোর গ্যাং কালচার দমানো যাচ্ছে না। দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে গ্যাংয়ে জড়িত কিশোররা।
সরকারি তথ্য-উপাত্ত ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে মাদক সেবন-চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-চাঁদাবাজি-মারামারি-আধিপত্য বিস্তার-ইভ টিজিংসহ হত্যাকাণ্ডের মতো সমাজে বড় বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু-কিশোর। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ এ প্রকাশিত ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে। ছয় বছরে এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। ২০২০ সালে অপরাধে জড়িত শিশুদের ৬১ শতাংশই ছিল ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে। যা ২০১৪ সালে ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে জার্নাল অব এমার্জিং টেকনোলজিস অ্যান্ড ইনোভেশন রিসার্চে প্রকাশিত ‘স্টাডি অব চিলড্রেন ক্রাইমস এট আরবান এরিয়াজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা মতে, বর্তমান সময়কালে অপরাধে শিশুদের সম্পৃক্ততা বেশ উদ্বেগজনক। তাদের মুষ্ঠিমেয়দের কর্মকাণ্ডে সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর।
উল্লেখ্য, প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শিশুদের ৭৫ শতাংশই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদকাসক্তি, মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, আগ্নেয়াস্ত্র বহন, ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হলো দরিদ্রতা ও শিক্ষার অভাব। অধিকাংশ শিশু ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সে অপরাধে যুক্ত হয়। ২০২১ সালে এশিয়ান জার্নাল অব সোশিওলজিক্যাল রিসার্চে প্রকাশিত ‘প্রসেস অব ক্রিমিনালাইজিং স্ট্রিট চিল্ড্রেন ইন বাংলাদেশ : এন এমপায়রিকাল স্টাডি ইন দ্য সিটি অব ঢাকা’ গবেষণাপত্র অনুযায়ী, অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের ৯০ দশমিক ৫ শতাংশই মাদক ব্যবসা এবং ৩০ দশমিক ১ শতাংশ হত্যার সঙ্গে জড়িত। তাছাড়া ছিনতাইয়ে ৬৬ শতাংশ ও চুরির সঙ্গে জড়িত শতভাগ গ্যাংয়ের সদস্য। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তন্মধ্যে ২৫টির সঙ্গে কিশোর গ্যাং সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। নামে কিশোর গ্যাং দলের এসব বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তারা ছিনতাই-চাঁদাবাজি-মাদক ব্যবসা-জমি দখলে সহায়তা-ইন্টারনেট সংযোগ-কেবল টিভি ও ময়লা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ-উত্ত্যক্ত করা-যৌন হয়রানি-হামলা-মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত। এরা শুধু অপরাধই করে না, অধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে।
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ২৩৭টি। তন্মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ১২৭টি দল সক্রিয়। বিগত সরকার পতনের আগে ঢাকায় এসব গ্রুপের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৮২। ২০২২ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ১৭৩টি এবং সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। অর্থাৎ দুই বছরে এর সংখ্যা বেড়েছে ৬৪টি বা ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে এসব দলের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার, যা আগের সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। এখন ঢাকার প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে ১ হাজার সদস্য রয়েছে। আর চট্টগ্রামে ৫৭টি কিশোর গ্যাংয়ে সদস্য রয়েছে ৩১৬।    
২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় ছাত্র হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি জনসম্মুখে উন্মোচিত হওয়ার পর দেশব্যাপী এর দ্রুত বিস্তার অতিশয় দৃশ্যমান। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’র সংঘাতের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। এসব অপরাধী সংগঠনের সঙ্গে কালক্রমে যুক্ত হয়েছে ‘বিগবস’, ‘কাশ্মীরী গ্রুপ’, ‘টিকটক অ্যাপ’, ‘ফার্স্ট হিটার বস’, ‘এফবিএএইচ’, ‘মোল্লা রাব্বি’, ‘স্টার বন্ড’  নামের বিভিন্ন কিশোর গ্যাং। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রুপে রয়েছে ভিন্ন পোশাক পরিচ্ছদ, চুল কাটার ধরন ও রঙের ভিন্নমুখী ব্যবহার।  বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনায় দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান অসমতা ও বৈষম্য সমাজে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ফলে ১৯৫৫ সাল থেকে বিপুল সংখ্যক কিশোর অপরাধী এবং গ্যাংয়ের উত্থান ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকতর অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা সহজে প্রাপ্তির কারণে কিশোর গ্যাং বেপরোয়াভাবে তাদের স্বাধীন সত্ত্বার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়।
বিশ্লেষকদের দাবি, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গ্যাংয়ের নেতাদের কেউ কেউ সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আবার কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় কতিপয় দানবতুল্য রাজনীতিবিদের। কিশোরদের একত্রিত করে এসব নষ্ট চরিত্রের ঘৃণ্য ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে ব্যবহার করছে। কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে আছে স্থানীয় পর্যায়ের অপরাধী চক্র ও দুর্বৃত্ত সংঘ। সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর আইনগত সহায়তাও দেয় আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া পৃষ্ঠপোষকরা। দুর্বৃত্তায়নে জড়িত কথিত রাজনীতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, কিশোরদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রথমে বিরোধ ও জোট বাধার প্রবণতা তৈরি হয়। সেখান থেকে প্রসারিত হয় গ্যাং সংস্কৃতি। একসময় সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার ও স্থানীয় মুরব্বিদের ভূমিকা ছিল। তাঁরা কিশোরদের বখাটেপনা প্রশ্রয় দিতেন না। এখন মুরব্বিদের জায়গাটি নিয়েছে দুষ্ট চক্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।
সচেতন মহলের ধারণা, যারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করবেন তাদের মধ্যে একটি অংশ অপরাধ সৃষ্টির অংশ হিসেবে কাজ করছেন এবং সেখান থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বলে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার ও সংশোধন প্রক্রিয়া চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এর বাইরে নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সে সুবাদে কিশোর গ্যাং নামে গজিয়ে ওঠা এই সামাজিক বিষফোড়ার ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। অন্যথায় রাজধানীসহ সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে উঠতি বয়সী এসব অপরাধীরা।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, ধ্বংসের তলানীতে পৌঁছানোর আগেই জনসংখ্যার তুলনায় স্বল্প সংখ্যক এসব কিশোর অপরাধী ও গ্যাং উপ-সংস্কৃতি নির্মূলে বিকল্প হিসেবে পর্যাপ্ত সংশোধনের ব্যবস্থা, কাউন্সেলিং-নিরাময় কেন্দ্র, উপযোগী কর্মসংস্থান, পরিবারের যথোপযুক্ত মনোযোগ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। একই সঙ্গে অপরাধীদের ও তাদের ইন্ধন-উৎসাহ দাতাদের কঠোর আইনের আওতায় আনা না গেলে এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি মহামারির রূপ ধারণ করবে - নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। ব্যক্তি-সমাজ-পরিবার সমেত জাতিরাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সতর্কতা ও সচেতনতা এবং শিশু-কিশোর সন্তানদের জীবন প্রক্রিয়ার গতিবিধি প্রতিনিয়ত নিগূঢ় তত্ত্বাবধান-পর্যবেক্ষণে রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিবিড় ভালোবাসা-আদর-স্নেহ এবং তাদের  দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনশীলতা পরিশীলিত- যৌক্তিক অনুষঙ্গ অনুসরণে সমস্যার সমাধানকল্পে দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই সমস্যা উত্তরণ ও পরিত্রাণের পথ-পন্থা উদ্ভাবনে সহায়ক হতে পারে।
লেখক : শিক্ষাবিদ

প্যানেল

×