
ষড়ঋতুর বৈচিত্রিক অঞ্চল আবহমান বঙ্গভূমি। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্তের পালাক্রমে নৈসর্গের যে লীলাখেলা তাও এই বরেন্দ্র ভূমির অনন্য শোভাবর্ধন। আর চিরায়ত অবিমিশ্র ভালোবাসায় সিক্ত বাংলার রূপশৌর্য যেন শাশ্বত মাধুর্যের অপরূপ মোহনীয়তা। শুরু হয়ে গেছে নব বসন্তের অনন্য যাত্রাপথ। শীতের আমেজের অন্তিম সময়ে ফাল্গুন মাসের শুভাগমন প্রাকৃতিক যে চিরায়ত সম্ভার তা যেন কোলের সন্তানদের মাতিয়ে দিতে আকুল হয়ে ওঠে। আর প্রেম-ভালোবাসা প্রতিদিনের নৃত্য সাহচর্যের আর এক নির্মাল্য। যা দিন, ক্ষণ, সময় নিরপেক্ষ। তার পরও বসন্তের সঙ্গেহ ভালোবাসার বন্ধন যেন প্রকৃতির মাঝে ঝরে পড়া হৃদয় বৃত্তির পরম আকুতি। সত্যিই অবাক কাণ্ড ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেখানেও আছে মজাদার এক গল্প কাহিনী। আর ঋতুসম্ভারের সবচেয়ে বর্ণিল আর সুশোভিত সময়টাও ১ ফাল্গুন ১৪ ফেব্রুয়ারি। আবার ফেব্রুয়ারি মাস শুধু ভালোবাসার আকৃতি কিংবা ফাল্গুনের নব বসন্তের ছোঁয়াই নয়। বরং দ্বৈত মিলন গ্রন্থিতে হয়ে ওঠে অন্য রকম চমৎকার সময় যাপন। ফেব্রুয়ারি মাস। কত না গৌরব আর সৌরভে মহিমান্বিত, ঐতিহ্যিক আর ঐতিহাসিক। আবার অমর একুশের শোকাবহ ঘটনাও এই ফাল্গুনকে কেন্দ্র করেই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আর ৮ ফাল্গুনের রক্তঝরা সময়ে শহীদানদের সিঁড়ি বেয়ে গড়ে ওঠা আর এক জাতীয়, উদ্দীপনামূলক শোকাবহ ঘটনার অনন্য পালাক্রম।
ফাল্গুনের নব বসন্তের ঝরাপাতার মর্মরধ্বনিতে প্রকৃতির যে ঐক্যতান তা এই উর্বর পলিমাটির অন্যমাত্রার শৌর্যবীর্য। যা ঐতিহাসিক, নৈসর্গির আর জাতীয় সংগ্রামের পালাক্রমে লাগাতার এক জীবনমরণ সংগ্রামী অভিযাত্রা। সালাম, জব্বার, বরকতসহ কত বীর ভাষা যোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষাকে সুরক্ষিত রাখতে হয় তাও ইতিহাসের করুণ রক্তাক্ত দলিল। মায়ের ভাষার জন্য এমন রক্ত আর জীবন বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশ দিয়েছে কি না তা আজ অজানা। ভালোবাসার পরম মাহাত্ম্যও এই আগুন ঝরা ফাগুন মাসের আর এ এক নবদ্যুতির ছটা বলাই যায়। বসন্ত আসে ঋতুর পালাবদলের নিয়মাফিকভাবে। আর হৃদয়ের বাতাবরণে যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দের ফোয়ারে গভীরতর প্রেমের যে অনাবিল শক্তি সেটাও যেন প্রেমের শিখরের নিত্য ওঠানামা। তবে ষড়ঋতুর নানামাত্রিক রূপান্তর শিল্প প্রযুক্তির উন্নত দেশগুলোতে সেভাবে অনুভূত না হওয়াও যন্ত্র সভ্যতার বিপরীত প্রদাহ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে নৈসর্গের যে অবারিত সবুজ শ্যামল বাতাবরণ ছিল তা বর্তমানে নিম্নগামী বলে প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা গত শতাব্দীর সূচনাকাল থেকেই আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন। বলা হচ্ছে প্রযুক্তির ক্রমপ্রসারণে বাতাসের অক্সিজেনই শুধু নয় চারপাশের পরিবেশও এক রুদ্রতা ও রুক্ষ্মতার জালে ধাবিত। যন্ত্র শিল্প যে ক্ষতিকারক কার্বন নিঃসরণ করছে তা বাতাস থেকে প্রকৃতির শ্যামল স্নিগ্ধতাকে তাকে ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতেও সময় নেবে না। যন্ত্র সভ্যতার ভয়াবহ কার্বন অতি দ্রুত নির্মল প্রকৃতির ওপর যে নেতিবাচক বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে তা আগামীতে কোন দগ্ধতার জালে নিপতিত হবে তাতে নৈসর্গ বিজ্ঞানীদের মাথায় হাত, চরম দুর্ভাবনার বিষয়ও। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লব যে নব্য প্রযুক্তিতে পৃথিবীময় নতুন যন্ত্র সভ্যতার উদ্ভাবন ঘটায় তাতে শান্ত, স্নিগ্ধ বিশ্ব এক জ্বলন্ত অগ্নি প্রদাহে নিয়তই ধাবিত হচ্ছে। ক্ষতিকারক যন্ত্র শিল্পের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হলে আগামীর মানুষ বাসযোগ্য কোন পৃথিবী পাবে কি না তা নিয়ে নৈসর্গ বিজ্ঞানীরা চিন্তিত, মর্মাহত। উন্মত্ত, অগ্নিদাহ যন্ত্র সভ্যতাকে সহনীয় করতে প্রকৃতি সহায়ক শিল্পের উদ্ভাবন যে কত জরুরি তা বলার অপেক্ষায় থাকেই না। আমরা এখন মাঘ মাসের অন্তিম সময় পার করে ফাল্গুন মাসের নব আনন্দের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু একটু ভাবলেই স্পষ্ট হয় ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’ চিরকালের এমন প্রবাদ অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের এক শতক না কাটতেই অধরা। ধরিত্রী উন্মুক্ত হওয়ার যে বিষবাষ্প উন্মুক্ত করল বাতাসে তা থামারই কোনো লক্ষণ নেই। বরং নিত্য নতুন উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীদের যে আধুনিক জয়যাত্রা তা সময়ের গতিতে কোন শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াবে তা নিয়ে নৈসর্গবিদরা দিশাহারা, চিন্তান্বিত, ব্যাকুল। শুধু কি সাবধান বাণী যন্ত্র সভ্যতার আধুনিকায়নের ওপরও ব্যবচ্ছেদ তৈরি করতে বারবার বিশ্বকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ফলশ্রুতিতে তার কোনো ইতিবাচক যা মানুষের দৃশ্যমান নয়। ভালোবাসা আর প্রকৃতিপ্রদত্ত শ্যামল বাতাবরণকে বিনি সুতার মালায় গেঁথে দেবে। মানুষের জন্য প্রয়োজন এক সহনশীল, দূষণমুক্ত, নির্মল আবহ। যা নিয়ন্ত্রণও করতে পারে প্রকৃতির কোলের সন্তানরাই। অষ্টাদশ শতাব্দীর আগ অবধি যে চিরায়ত সবুজ প্রান্তর সারা বিশ্বকে ছায়াঘেরা, মায়া ভরা পরিবেশ উপহার দিয়েছে তাকেই নতুন সময়ের অনুষঙ্গ করতে হবে। চিরায়ত শ্যামল প্রকৃতিকে সুরক্ষা দিয়েই। সবার আগে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে যেভাবে বন্য মানুষরা টিকে ছিল। আধুনিকতার নবউদ্ভাবনকেও ক্রমান্বয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে সে শ্যামল প্রকৃতিকে আর কোনোভাবেই নয়-ছয় নয়। সবুজ প্রান্তরকে তার চিরায়ত শৌর্যে ফিরিয়ে যা করার দরকার সবই আধুনিক নব্য সভ্যতার মানুষদের নিয়ন্ত্রণেই। মানুষ তার নিজের ভাগ্যবিধাতা। পাশাপাশি পরিবেশ নিয়ন্ত্রণেও সৃষ্টির সেরা মানুষই পারে সব দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দুর্বার গতিতে নৈসর্গ আর কোলের সন্তানদের সুরক্ষিত রেখে নতুন আলোকিত এক সুন্দর বিশ্ব উপহার দিতে। প্রযুক্তির ব্যবহার নিতান্ত জরুরি তাতে সন্দেহ নেই। তবে কোলের সন্তানদের সুস্বাস্থ্য এবং নির্মল পরিবেশও তার চেয়ে বেশিই প্রয়োজন। নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষা দিতে প্রযুক্তিকে সহনীয় এবং প্রকৃতি সহায়ক বাতাবরণের অধীন করবে। তাতে চিরায়ত নৈসর্গ যেমন অগ্নিদাহ থেকে সুরক্ষা পাবে- একইভাবে বিশ্ববাসীও পরম স্বস্তিদায়ক পরিবেশকে আলিঙ্গন করে জীবনমানকে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যাবে।