বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় কোনো না কোনো পণ্য পাওয়া যায়,যা অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দেশের বিভিন্ন জেলায় বা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে নানা ধরনের পণ্য পাওয়া যায়। এসব পণ্যের দাম বা নাম অনেকে জানেন না, কেউ খোঁজও রাখেন না। স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করা হয় বলে এসব পণ্যের পরিচিতিও বাড়েনা।
‘ওয়ান ডিস্ট্রিক্ট ওয়ান প্রোডাক্ট’ (ঙউঙচ) ধারণাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আঞ্চলিক অর্থনীতিকে উন্নীত করার একটি প্রমাণিত মডেল। এটি স্থানীয় সম্পদ এবং দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি জেলার একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা পরিষেবাকে উন্নীত করার মাধ্যমে আঞ্চলিক এবং জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যার প্রতিটি জেলা অনন্য ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং উৎপাদনে সমৃদ্ধ। তাই, ঙউঙচ ধারণাটি এ দেশে একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে, যেখানে প্রতিটি জেলার নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি হবে এবং বিশ্ববাজারে স্থানীয় পণ্য পৌঁছে দিতে সহায়তা করবে।
ঙউঙচ-এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি জেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা পরিষেবা চিহ্নিত করা এবং সেই পণ্য উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি, মানোন্নয়ন, এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা করা। এর মাধ্যমে স্থানীয় স¤প্রদায়ের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাপী এই ধারণা সফল হয়েছে যেমনÑ ১.জাপানে ‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট’ (ঙঠঙচ): এটি স্থানীয় পণ্যকে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত করেছে। ২.ভারতে ঙউঙচ উদ্যোগ: প্রতিটি রাজ্যের জেলাভিত্তিক পণ্যকে বিশ্ববাজারের সাথে পরিচিত করেছে। বাংলাদেশেও এই মডেল স্থানীয় অর্থনীতি এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার নিজস্ব কিছু পণ্য এবং ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। যেমনÑ রাজশাহীর সিল্ক, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম, কক্সবাজারের শুটকি মাছ, নোয়াখালীর খেজুরের গুড়, সিলেটের চা,বরিশালের শীতলপাটি, কুমিল্লার রসমালাই। প্রতিটি জেলায় নির্দিষ্ট এই পণ্যগুলোর উৎপাদন ও বিপণনকে কেন্দ্র করে যদি পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এবং এসব পণ্য আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
ঙউঙচ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা নানারকম সুবিধা পেতে পারি। তার মাঝে হলোÑ নতুন কর্মংস্থানের সৃষ্টি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন,রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ, দারিদ্র্য বিমোচন, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সংরক্ষণের মাধ্যমে গুরত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে।
রপ্তানি পণ্যের বহুমুখী করণের জন্য ১৬ বছর আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর নেওয়া ‘এক জেলা এক পণ্য’ উদ্যোগটি মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এই ব্যর্থতার কারণ কখনও খোঁজে দেখিনি, যার ফলশ্রুতিতে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার নানা রকম কারণ হতে পারে। যেমনÑ ১. অবকাঠামোগত দুর্বলতা ২. প্রযুক্তিগত ঘাটতি ৩. বাজারজাতকরণের সমস্যা ৪. সরকারি সহযোগিতার অভাব ৫. মান নিয়ন্ত্রণ এবং ব্র্যান্ডিং।
আমরা এই ব্যর্থতার গøানি মুছে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি, যাতে করে দেশীয় পণ্য বিশ্বদরবারে পরিচিত লাভ করে। তার মাঝে কিছু হলো - ১. গ্রামীণ এলাকাগুলোতে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ এবং উৎপাদন সুবিধা বাড়াতে সরকার এবং বেসরকারি খাতকে একত্রে কাজ করতে হবে ২.স্থানীয় উৎপাদকদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এটি পণ্যের মান বাড়াতে এবং উৎপাদনের খরচ কমাতে সহায়ক হবে। ৩. অনলাইনে পণ্য বিপণনের জন্য একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের পণ্য সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন।
৪.সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্র ঋণ ও তহবিল প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা শুরু বা স¤প্রসারণ করতে পারেন। ৫.স্থানীয় পণ্যের ব্র্যান্ডিং এবং আন্তর্জাতিক বিপণনে বিনিয়োগ করতে হবে। প্রতিটি পণ্যকে একটি জিআই ট্যাগ দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যা পণ্যটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুরক্ষা এবং স্বীকৃতি দেবে।
‘ওয়ান ডিস্ট্রিক্ট ওয়ান প্রোডাক্ট’ ধারণা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিকাশের একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করতে পারে। প্রতিটি জেলা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং সম্পদের জন্য অনন্য।
ঙউঙচ উদ্যোগের মাধ্যমে এই বৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। যদি সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একত্রে কাজ করে, তবে ঙউঙচ বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সামগ্রিক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী মডেল হয়ে উঠতে পারে।
এটি শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই আনবে না, বরং আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জাতীয় পরিচয়কে আরও মজবুত করবে। বাংলাদেশে ঙউঙচ বাস্তবায়ন হলে তা দেশের নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং বিশ্বমানচিত্রে স্থানীয় পণ্যের নতুন পরিচিতি তৈরি করবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
কুতুব