.
‘বাংলা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত বইয়ের ভবিষ্যৎ কী? বইয়ের পাঠক কি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে? নতুন প্রজন্ম কি আর বই পড়বে না? ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই থেকে বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। সত্যি কি বাংলা বইয়ের পাঠক সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে? বইয়ের ভবিষ্যৎ কি খুব খারাপ? যুক্তরাষ্ট্রে গড়পড়তা সবাই মোটামুটি বই পড়েন। তারা বইকে জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছেন। বই ভালোবাসে না সেখানে এমন লোক পাওয়া খুব কঠিন। সেদেশে রাস্তার ফুটপাতে বসে, বাসে, পাতাল ট্রেনে, পার্কের বেঞ্চে এমনকি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও বইপাগল মানুষগুলো বইয়ের রসে নিজেদের ডুবিয়ে রাখেন। কিন্তু গড়পড়তা বাঙালি কি বই পড়েন? নাকি তারা বই নামক বস্তুটি থেকে তাদের মুখ তুলে নিয়েছেন? বই কি শুধুই একটি পণ্য? পড়ার সময় কোথায়?’ চা-শিঙাড়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা আর তর্কবিতর্ক করতে পারেন, কিন্তু একটা বই হাতে নিয়ে দেখার সময় আপনার হয়ে ওঠে না। আজ থেকে প্রায় একশ’ বছর আগে সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত ‘বইকেনা’ রম্য রচনাটির কথা আবার নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
ঢালাওভাবে বলা হয়, মানুষ নাকি এখন আর বই পড়ে না। কথাটা আংশিক সত্য। মানুষ আগের মতো বই পড়ে না। তাতে কী? মানুষ তো আগের মতো রেডিওও শোনে না। আগের মতো ক্যাসেটে গান শোনে না। তাতে কি রেডিও বা গানের জগৎ বন্ধ হয়ে আছে? বরং নানা দৃষ্টিকোণে তাদের বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ার মতো। মানুষ আগের ফর্মে হয়তো বই পড়ে না। তাই বলে বইপড়া বা পড়ার রেওয়াজ থামেনি। বলছিলাম এই কারণে, অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী সিডনির বইয়ের দোকানগুলো এখনো সমানে ব্যবসা করছে। নতুন নতুন বইপত্রে ঠাসা দোকানগুলোতে ক্রেতাও কম নয়। একেকটি বইয়ের বিক্রি ও এডিশনের সংখ্যাই বলে দেয় বইয়ের জগত যেন আবার জেগে উঠছে। জেগে যে উঠছে সেটি বাংলা বইয়ের মেলাতেও টের পাই। একেবারে নতুন লেখকদের বইও চলে দেদার।
আমাদের এই কসমোপলিটন শহরে দুনিয়ার প্রায় সব দেশের মানুষের পাশাপাশি বাংলাদেশীরাও আছেন। ভালোভাবে দাপটের সঙ্গেই আছেন। বাড়তে বাড়তে প্রায় তিরিশ-চল্লিশ হাজার বাঙালি মতান্তরে ৫০ হাজারের বেশি এই সংখ্যা এখন ফুলে-ফেঁপে বটবৃক্ষ। কত রথী-মহারথী আসেন, যান। খবর রাখাও দায়। বিদেশের বাঙালি সজ্জন এই কথাটা সঞ্জীব চন্দ্র একটুও ভুল বলেননি। তেমন কেউ এলেই আমরা তাদের নিয়ে আসর মাতাই। অনুষ্ঠান হয়। সে অনুষ্ঠানে গাঁটের টাকা খরচ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অতিথিদের অনেকেই জানেন না, এই ডলার জোগাড় করতে কাউকে ওভারটাইম, কাউকে বেশি পরিশ্রমও করতে হয়। কিন্তু তাতে কী? আনন্দ আর আতিথেয়তা কি বন্ধ থাকে বাঙালির?
এবার এসেছিলেন দীপংকর দাশ। দীপংকরকে আপনি চেনেন আর না চেনেন, বাতিঘর নামটি নিশ্চয়ই আপনার চেনা। চেনা সে সব বইয়ের দোকান, যেগুলো বাতিঘর নামে আলো ছড়িয়ে চলেছে। বাতিঘরের কর্ণধার দীপংকরকে আমি চিনি অনেক বছর ধরে। সে যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার বা লাইব্রেরির ভ্যানগাড়ি নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন থেকে জানি। জীবনের শুরুতেই পিতৃহারা দীপংকর সংগ্রামী যুবক। তার কাছে শেখার বিষয় এই, সংকল্প আর জেদ দিয়ে সে বৈরী পরিবেশকে বশে এনেছে। পেরেছে এমন একটা বাতিঘর প্রতিষ্ঠা করতে, যার আলো চট্টগ্রাম-ঢাকা-সিলেট হয়ে এখন সারাদেশে আলো ছড়িয়েছে। এও এক ধরনের সামাজিক বিপ্লব। যখন মানুষ বইপড়া ভুলে ডিজিটাল মিডিয়ায় ই-বুক পড়ছে, যখন ভিডিও চাপে দৃশ্যমানতার প্রভাবে চোখ খুলে কান বন্ধ করে রাখছে, তখন আবার পাঠকের ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দেওয়া বাণিজ্যের পাশাপাশি এক মহতী সংগ্রামই বটে।
আমরা তাকে নিয়ে বসেছিলাম এক সন্ধ্যায়। প্রশান্তিকা নামে আমাদের যে লাইব্রেরি এবং বইয়ের প্রতিষ্ঠান তার মালিক আতিকুর রহমান শুভ ছিল উদ্যোক্তা। ছিল তার অনুজ এখন জনপ্রিয় লেখক আরিফুর রহমান। নামের তালিকা না দিয়ে বরং বলি অগ্রজ সমাজকর্মী নেতা গামা আবদুল কাদিরের সূচনার পর সবাই মূলত দীপংকরের কাছে প্রশ্ন রাখছিল, কীভাবে প্রবাসীদের সঙ্গে যুক্ত করা যায়? মানতে হবে প্রবাসীদের রেমিটেন্স গ্রহণে দেশের যতটা আগ্রহ, তাদের স্বীকৃতির বেলায় ততটা দেখা যায় না। সবাই জানেন এবং মানেন পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের সবাই প্রায় সচ্ছল। আর এই সচ্ছলতা তাকে যা ইচ্ছে কিনতে প্রলুব্ধ করে। ফলে, দীপংকরের বাতিঘর যে প্রশান্তপাড়েও বাণিজ্যের ডানা বিস্তার করতে পারে, এটাই সত্য।
সে সন্ধ্যায় প্রশ্নোত্তর পর্বে লেখক সাফিন রাশেদ ও মনোবিদ জন মার্টিনের প্রশ্নগুলো ছিল যথাযথ। প্রকাশক উত্তর দিয়েছেন সঠিকভাবে। বাংলা ও বাঙালির নবীন-প্রবীণ লেখকের সঙ্গে বিদেশের মেলবন্ধন না হলে জাতি হিসেবে আমরাই পিছিয়ে পড়ব। আমাদের সাহিত্যের অনুবাদ যে জরুরি, সে কথাও বলেছেন লেখক শাখাওয়াৎ নয়ন। সমাজকর্মী নোমান শামীমের কথাগুলো আমার ভালো লেগেছে। এমন অনুষ্ঠানের পেছনে থাকেন মো. শফিকুল আলম। যার সহৃদয় সহযোগিতা শিরোধার্য। সেদিন পূরবী পারমিতা বোসও দারুণ বলেছিলেন।
[email protected]