
এসএসসি ফলাফল বিপর্যয়ের একাধিক কারণ জানালেন শিক্ষকরা
রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌরসভার শিক্ষা ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের চিত্র উঠে এসেছে এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে। সেই সাথে এসএসসি ফলাফল বিপর্যয়ের একাধিক কারণ জানালেন হারাগাছ অঞ্চলের শিক্ষকরা।
পৌরসভার অন্তর্গত ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এবার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মোট ৯৯৩ জন ছাত্র-ছাত্রী। এর মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৫৩৪ জন। আর অকৃতকার্য হয়েছে ৪৫৯ জন শিক্ষার্থী। এই অঞ্চলে পাশের হার দেখা যায় মাত্র ৫৩.৭৭% এবং ফেল করেছে ৪৬.২৩% শিক্ষার্থী। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যতিক্রম কিছু বিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেশি। হারাগাছ হাই স্কুলে ২৬০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১২৮ জন, ফেল করেছে ১৩২ জন। দরদী হাই স্কুলে ২৩০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৯৯ জন পাস করলেও ফেল করেছে ১৩১ জন। আলেফ উদ্দিন সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩৫ জনের মধ্যে মাত্র ৯ জন পাস করেছে, ফেল করেছে ২৬ জন। নবীজন নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পাস করেছে ১৫ জন, ফেল করেছে ২৪ জন। মুন্সিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফেল করেছে ২৯ জন।
তবে পোদ্দাড় পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভালো ফলাফল করেছে— ৯১ জনের মধ্যে ৬৫ জন পাস করেছে। বাংলাবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৮১ জনের মধ্যে পাস করেছে ১২১ জন, ফেল করেছে ৬০ জন। আহমদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৮ জন পাস করেছে, বাকি ১৯ জন ফেল করেছে। ঘুমেরকুটি উচ্চ বিদ্যালয়েও ফলাফল হতাশাজনক— ৭৪ জনের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৩৪ জন, ফেল করেছে ৪০ জন।
এই ফলাফলের পেছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলা হলে তারা একাধিক কারণ তুলে ধরেন। অনেকেই মনে করেন, করোনাকালীন সময়ে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অটোপাসের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। তদুপরি, এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোবাইল আসক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় এবং নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না হওয়া ফলাফলের ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে। কিছু প্রধান শিক্ষক আবার শিক্ষার মানহানির জন্য দায়ী করেছেন বাল্যবিবাহ, ঝরে পড়া এবং অভিভাবকদের অবহেলাকে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে হওয়ায় তাদের স্কুল জীবন মাঝপথেই থেমে গেছে। অনেকেই অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতাকেও দোষারোপ করেন।
আরেকটি গুরুতর অভিযোগ এসেছে কিছু প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে। তারা বলেন, বিগত সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির মাধ্যমে কিছু অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছে। এদের অনেকেই পাঠদানে উদাসীন এবং দায়িত্ব পালনে অক্ষম। ফলে ক্লাসে পাঠদানের মান নিম্নমুখী হয়েছে। অনেকে বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্ত করে এনটিআরসি (NTRCA) এর মাধ্যমে মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে।
এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘স্কুলে এখন রাজনীতি বেশি, পড়াশোনা কম। অযোগ্য শিক্ষক ও প্রধানদের কারণে আমাদের সন্তানরা বারবার ফেল করছে। রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ না হলে শিক্ষার মান আরও খারাপ হবে।’’ শিক্ষাবিদদের মতে, শুধুমাত্র শিক্ষার্থী নয়— শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি, দুর্বল প্রশাসনিক তদারকি ও সরকারি নীতিমালার দুর্বল বাস্তবায়ন মিলিয়ে এই ফলাফলের জন্য সবাইকে দায় নিতে হবে।
শিক্ষার মান অবনতির পেছনে অটোপাস, মোবাইল আসক্তি, বাল্যবিবাহ ও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দায়ী বলে দাবি প্রধান শিক্ষকদের।
এত সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফেল করা কেবল পরীক্ষার ব্যর্থতা নয়, এটি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি। এখনই জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে এ ধ্বংস আরও গভীর হবে।
তাসমিম