ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে শিশুরা

শতদল বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২ অক্টোবর ২০২৪

দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে শিশুরা

দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে শিশুরা

এক অভিজাত বাসায় কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলাপরত অবস্থায় দেখলাম এক শিশু পড়ছে বই একেবারে চোখের সামনে এনে। আমাদের আলাপের প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলাম, শিশুটি এভাবে পড়ছে কেন? গৃহকর্তাও অবাক হয়ে জানতে চাইল শিশুটি এভাবে পড়ছে কেন। এবার পরিবারের সবাই আসল ঘটনা কি জানতে চাওয়ায় সে বলল, দূর থেকে সে পড়া দেখতে পায় না। তাই বই কাছে এনে পড়ছে। শিশুর এ অবস্থা আগে কেউ টের পায়নি। পরামর্শ দিলাম অবিলম্বে চোখের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে। 
ঢাকা একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ শিশু’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে জানা যায়, বিশ্বের প্রতি তিনজন শিশুর একজন মায়োপিয়া নামের চোখের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে, যা আদৌ সুখবর নয়। শিশুরা কি করছে না করছে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। তারা কিভাবে পড়ছে, কোনো অস্বস্তিতে আছে কিনা খেয়াল রাখলে সমস্যা সহজে দূরীভূত করা সম্ভব। যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞদের একটি দলের গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের ৫০ লাখ বিভিন্ন বয়সী শিশুর তথ্য সংগ্রহ এবং সেসব তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গবেষণা প্রবন্ধ প্রস্তুত করেছে তারা।

ব্রিটেনের বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী জার্নাল অব অপথামোলজিতে প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, গবেষকরা বলেছেন, এশিয়া মহাদেশের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। এই মহাদেশের অধিকাংশ শিশু দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে। অপ্রিয় সত্যি কথা হলোÑ প্রায় শিশুর অভিভাবকরা তাদের শিশু যে দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে, সে কথা জানে না। শিশুরা এই সমস্যা বিষয়ে মা-বাবাকে কিছু জানায়ও না। মা-বাবা জানলে তো মোবাইল ব্যবহার করতে দেবে না, এই ভয়ে। 
জাপানের ৮৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ৭৩ শতাংশ শিশু আক্রান্ত মায়োপিয়ায়। চীন এবং রাশিয়ার ৪০ শতাংশ শিশু এ রোগে আক্রান্ত। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের মোট শিশুদের ১৫ শতাংশ ভুগছে মায়োপিয়ায়। উল্লিখিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বছরে বিশ্বজুড়ে দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের হার বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি। মায়োপিয়া রোগটি মূলত জেনেটিক।

রক্তসম্পর্কিত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের এ সমস্যা থাকলে উত্তরাধিকার সূত্রে তা শিশুদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। অবশ্য এ বিষয়ে গবেষকরা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, শিশু জন্মের পর থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের চোখ গঠিত হতে থাকে। এ সময়ের মধ্যে যদি চোখের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, তাহলে ওই শিশু মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং তা প্রায় নিরাময়যোগ্য নয়। 
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের গড়ে ৭-৮ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। করোনা মহামারির পর শিশুদের মায়োপিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরের বেশির ভাগ শিশুর দৃষ্টি সমস্যার বড় কারণ নাকি এটি। করোনা মহামারির পর অনেকে ঘরবন্দি হয়েছে। এর মধ্যে শিশুরা অন্যতম। শিশুদের লেখাপড়ার চাপ না থাকায় ওই সময়ের পর থেকে প্রায় শিশু ঘরবন্দি থাকার কারণে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা সময় কাটিয়েছে মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা টেলিভিশনের পর্দার দিকে চোখ রেখে।

এসব ইলেকট্রিক গেজেট থেকে নির্গত ক্ষতিকর রশ্মি দিনের পর দিন চোখে ঢুকলে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। বিশেষ করে শিশুরা দূরের জিনিস কম দেখতে পায়। ছেলেদের চেয়ে মেয়ে শিশুরা চোখের সমস্যায় বেশি ভোগে। কারণ, ছেলে শিশুরা দিনের বেলায় ঘরের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করে। তারা নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। এভাবে দিনের অধিকাংশ সময় ছেলে শিশুরা ঘরের বাইরে কাটায়। মেয়ে শিশুরা তেমন একটা ঘরের বাইরে যায় না। সময় কাটায় মোবাইল, টেলিভিশন, ল্যাপটপ নিয়ে। যে কারণে তুলনামূলকভাবে মেয়ে শিশুরা বেশি দৃষ্টি সমস্যায় ভুগে ছেলে শিশুদের চেয়ে। গবেষকদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি শিশু মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

এক চক্ষু বিশেষজ্ঞ থেকে জানতে পারলাম, বর্তমান সময়ে নাকি শিশুদের নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে বেশি। কারণ ওই একটাই, আধুনিক যুগের নানা প্রযুক্তি বিশেষ করে মোবাইল, টেলিভিশনে বেশি আসক্ত শিশুরা। অভিভাবকরা যদি তাদের শিশুদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ না করে, তাহলে শিশুদের দৃষ্টি সমস্যা দূর তো হবেই না, বরং পরিবারে অশান্তি বিরাজ করবে। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রায় শিশুদের নানা পাওয়ারের চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। এতেও কিন্তু সফলতার পাল্লা নি¤œগতির।

চশমা দোকানিরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বলেও জানালো এক চশমা দোকানি। যা হোক, এ সমস্যা রোধে নিজ নিজ পরিবার থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন সময়ের দাবি। শিশুদের আবদার রাখতে গিয়ে পরোক্ষভাবে আমরা মারাত্মক ব্যাধির কবলে ঠেলে দিচ্ছি তাদের। তাই আসুন গবেষক, বিজ্ঞজন, চিকিৎসকসহ যারা এ বিষয়ে অহোরাত্র কাজ করছেন, তাদের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে দেশে আগামী প্রজন্মের নিরাপদ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মনোযোগী হই। পরিশেষে, বিশ্বের সকল শিশুর অনাগত দিনগুলো ভালোভাবে কাটুক, এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করি। 
লেখক : সাংবাদিক

×