ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১

চব্বিশের জনযুদ্ধ

জলি রহমান

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চব্বিশের জনযুদ্ধ

চব্বিশের জনযুদ্ধ

দুই-তিন মাস পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গ্রোসারিশপের কথোপকথনেও সবাই যেন ছিল ক্ষমতাসীন সরকারের আজ্ঞাবহ। কোনো বিষয়েই প্রায় দ্বিমত নেই। আর থাকলেও তা দমনের জন্য ছিল আয়নাঘরের মতো নানা ব্যবস্থা। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বিগত ১৬ বছর যাবত ক্রমান্বয়ে আটকে যাচ্ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলে।

লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতির মন্দাভাব এবং সম্পদের অসম বণ্টনে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। যার দাবানল বিস্ফোরিত হয়েছে জুলাই-আগস্টে। অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৬ বছরের দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয় দেশ। এ আন্দোলনে প্রায় ৮০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। দৃষ্টিশক্তি হারান ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন শতাধিক মানুষ। রাজপথে আরও কত মানুষের রক্ত ঝরেছে, তার হিসাব পাওয়া সহজ নয়। এত এত মানুষের রক্তের বিনিময়ে পতন হয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকারের।  
আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধের মতো শত শত তাজা প্রাণের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলার রাজপথ। প্রথমে কোটা সংস্কারের আন্দোলন হলেও ক্ষমতাসীন সরকারের উচ্চ মহলের নানা বিতর্কিত কথায় ক্রমেই তা রূপ নেয় এক দফা আন্দোলনে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হন দেশ ছেড়ে পালাতে। পাঁচ আগস্ট শহরের প্রতিটি রাজপথ জনগণের পদচারণায় ছিল মুখরিত। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

তবে টিভির স্কিনে চোখ রেখে হয়েছি শিহরিত। ইন্টারনেট, মোবাইল জেঁকে বসেছে আমাদের মস্তিষ্কে। তাই অভিভাবকরা খুবই বিচলিত ছিলেন এ যুগের ছেলেমেয়েদের দিয়ে কি হবে! সারাক্ষণ মোবাইল দেখে কাটাচ্ছে সময়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এবার প্রমাণ করেছে তারা কতটা ভাবেন দেশকে নিয়ে। বুক চিতিয়ে দিয়েছেন পুলিশের গুলির সামনে। চার দেয়ালের মধ্যে বড় হওয়া ছেলেমেয়েগুলো এত সাহসী কিভাবে হলো তা অবাক করে দিয়েছে বিশ্বকে।

রেমিটেন্স যোদ্ধারা প্রবাসী আয় বন্ধ করে আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানিয়েছেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে প্রতিটি সচেতন নাগরিক উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। ৫ আগস্ট সকালেও আমরা ভাবিনি দুপুরের মধ্যে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পাওয়া যাবে। দুপুর তিনটার সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। ফলশ্রুতিতে জনমনে স্বস্তি ফিরতে শুরু করে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টাসহ এ সরকারের সদস্যসংখ্যা ২১। উপদেষ্টাম-লীতে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ।

এ ছাড়াও আছেন প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারী এবং একজন আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত। ছাত্রদের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 
শুরু হয় রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ। কিন্তু হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত বন্যা এসে সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। দেশের ১১টি জেলায় বন্যায় এখন পর্যন্ত ৭১ জনের মৃত্যু এবং ৫০ লাখ ২৪ হাজার ২০২ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

বন্যা মোকাবিলায় একত্রিত হয় বিত্তবান থেকে সকল সাধারণ মানুষ। যে যার সাধ্য মতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আবারও এদেশের মানুষ প্রমাণ করে দিল দেশের কোনো সমস্যা কিভাবে একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করতে হয়। 
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান শুধু দেশেই নন, বিশ্বনন্দিত তিনি। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের সকল খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। ইতোমধ্যে ১০টি ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে নয়টির মালিকানা এস আলম গ্রুপের। স্থগিত করা হয়েছে সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাসহ অনেকের ব্যাংক হিসাব।

ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। শেয়ারবাজারে বেক্সিমকো, লা মেরিডিয়ান হোটেলসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গঠন করা হয়েছে কমিটি। বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সিআইডি। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বিগত সরকারের অবৈধ প্রভাবশালীদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতের অস্থিরতা দূর করতে প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টাও লক্ষ্যণীয়।
সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রেখে বিদায় নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নিঃসন্দেহে অনেক সময় লাগবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক একটি বিষয় হলো তিনজন অর্থনীতিবিদ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।

শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। প্রধান উপদেষ্টাও একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ। ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩তম গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) উচ্চ পদে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবার ঘুরে দাঁড়াবে বলেই প্রত্যাশা।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে চলছে সংস্কারমূলক কাজ। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ হবে গণশুনানির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশে নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ৬৪ জেলায় অন্তত ৬৪টি নদী চিহ্নিত করে নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

৫ সেপ্টেম্বর গণভবনকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। তবে সময় দিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ মানুষ। তার কাছে কোন জাদুর কাঠি নেই, যে চোখের পলকে ১৬ বছরের অনিয়ম পাল্টে দেবেন। 
সবশেষে, শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতি বা দেয়াল লিখনে যেসব ছোট ছোট বাক্য ঝড় তুলেছিল প্রতিটি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তা উল্লেখ করে এ নিবন্ধন শেষ করব - কে রাজাকার?, না দিয়ে অধিকার বলে রাজাকার, লাশ দাফন হবে কোন কোটায়, মেধা হত্যার বিচার চাই, লাশের ভেতর জীবন দে নইলে গদি ছাইড়া দে, দেশটা কারও বাপের না, ১৮ কোটি বুলেট আছে তোদের?,

স্বৈরাচার আর কয়দিন, অধিকারের লড়াই, এ বয়স হার মানার নয়, মোরা সাঈদ, মোরা রাফি, মোরা মুগ্ধ সময়ের আলোড়নে হব সিংহ, পানি লাগবে কারও, পানি?, শহীদ মীর মুগ্ধ, ১ দফা, হাসিনাকে নামতে হবে, বিপ্লবের রং মোছা যায় না, আমরা ৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি, শোকের মাস জুলাই আগস্ট নয়, বাংলা ছাড়, তারা কি ফিরবে আজ সুপ্রভাতে, গণজোয়ার, খুনি কে?,

চলছে রক্তের ফাগুন, দেশ আমার কারও বাপের না, গদি ছাড় স্বৈরাচার, কুমিরের কান্না, বিবেক কোথায়?, বিবেক লাগবে?, ওরা মোর মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়, চুপ করতে চাইলেই কি চুপ করানো যায়, নাটক কম কর পিও, বুকের ভেতর অনেক ঝড় বুক পেতেছি গুলি কর, লাগবে না তোর অধিকার, ফিরিয়ে দে ভাই আমার, চব্বিশের জনযুদ্ধ ইত্যাদি।
লেখক : সাংবাদিক

×