সৃজনশীল সাংস্কৃতিক চর্চা এবং মত প্রকাশের পরিসর
দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের বড় এক অংশ সুবিধাবাদী রাজনীতির স্রোতে এমনভাবে গা ভাসিয়েছেন যে, তাদের পক্ষে দলীয় ধ্বজা তুলে ধরা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হয়নি। তরুণদের অনেকের মধ্যেও এ প্রবণতা প্রকট। সুপ্রিম পাওয়ারকে খুশি রাখতেই তাদের যাবতীয় প্রতিভা খরচ। এতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ। নগদ অর্থসহ আরাম-আয়েশের জীবনযাপনের নিশ্চয়তা জোটে। কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় না। আরাম-আয়েশের জীবন সহজেই অর্জন করা যায় বলে পরিশ্রমবিমুখ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে
পলিটিক্যাল থিয়েটার বা রাজনৈতিক নাটকের উদ্ভব হয়েছিল বিশ্ব রাজনীতির সংকটময় এক সময়ে। জার্মান নাট্যকার এরভিন পিসকাটর নাটকের জগতে নতুন এক ধারা সৃষ্টি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে জার্মানির তখন দেউলে হওয়ার দশা। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সংকট যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।
পরাজিত রাষ্ট্র হিসেবে ক্ষতিপূরণের টাকা গুনতে গুনতে নিঃস্ব জার্মানি। জনগণের দুঃসহ অবস্থা পিসকাটরকে প্রতিবাদী নাট্যকারে পরিণত করেছিল। তার সময়ে আরেক নাট্যকারও রাজনৈতিক বক্তব্য প্রধান নাটকের জন্য বিশ্বখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বের্ট্রোল্ট ব্রেশট। নাটকের মধ্য দিয়ে জনগণের কথা বলেছেন তারা।
চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টির পথিকৃৎ আমেরিকান চলচ্চিত্রকার ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ। রাষ্ট্র ও সমাজের আরেক সংকটকালকে ধরেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘বার্থ অব এ নেশন’ চলচ্চিত্রে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে দু’জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে কেন্দ্রে রেখে কাহিনী আবর্তিত হলেও চলচ্চিত্রকারের দৃষ্টিতে ওই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক সংকটই আসলে এ চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। চলচ্চিত্র বিস্তৃত ক্যানভাসে জীবনের বহুমাত্রিকতাকে ধরতে পারে। যদি পেছনে থাকে সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার।
ভারতীয় চলচ্চিত্রকার বিশাল ভরদ্বাজ দু’হাজার চৌদ্দ সালে নির্মাণ করেন ‘হায়দার’। ভারতের কাশ্মীরের রাজনৈতিক সমস্যার পটভূমিতে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী, জঙ্গী রাজনীতি এবং এ দুয়ের সমন্বয় সাধারণ মানুষের জীবনের বিপর্যস্ততা যেভাবে শৈল্পিক নৈপুণ্যে উঠে এসেছে তা সত্যিই অভিনব।
কাহিনী বিন্যাসে শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’কে অবলম্বন করেছেন পরিচালক। কাশ্মীরের মতো দ্বন্দ্ব-ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিবেশকে হ্যামলেটের ট্র্যাজিক আবহের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে একই সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্যনির্ভর ও শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রের স্বাদ দিয়েছেন। নির্মাণশৈলীও অসাধারণ। রাজনীতি, সমাজ ও জীবনকে সূক্ষ্মভাবে দেখার, বোঝার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা থেকেই এ ধরনের শিল্পকর্ম নির্মাণ সম্ভব। স্বার্থের রাজনীতির কাছে মাথা বিক্রি করে সৃজনশীল কাজ করা যায় না।
কাহিনী নির্মাণের অসংখ্য উপাদান ছড়িয়ে আছে আমাদেরও চারপাশে। কিন্তু এ নিয়ে কাজ হচ্ছে না প্রায় কোনো মাধ্যমেই। পুরোটাই কি সৃজনশীলতার অভাব? নিশ্চয়ই নয়।
দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের বড় এক অংশ সুবিধাবাদী রাজনীতির স্রোতে এমনভাবে গা ভাসিয়েছেন যে, তাদের পক্ষে দলীয় ধ্বজা তুলে ধরা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হয়নি। তরুণদের অনেকের মধ্যেও এ প্রবণতা প্রকট। সুপ্রিম পাওয়ারকে খুশি রাখতেই তাদের যাবতীয় প্রতিভা খরচ। এতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ। নগদ অর্থসহ আরাম-আয়েশের জীবনযাপনের নিশ্চয়তা জোটে। কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় না। আরাম-আয়েশের জীবন সহজেই অর্জন করা যায় বলে পরিশ্রমবিমুখ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ডকুমেন্টারি, ডকুফিকশন ইত্যাদি নির্মিত হতে পারে। কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমস্যার গভীরে যাওয়া এবং এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার সৎ প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে রাজনৈতিক ব্যাধির গভীরতম কারণ। এ নিয়ে দশ, বিশ বা পঁচিশ মিনিটের ডকুমেন্টারি তৈরি হতেই পারে। কিন্তু এ রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
এমনকি কোনো টেলিভিশন চ্যানেলেও না। এর কারণও ওই পক্ষে-বিপক্ষের রাজনীতি। টিভি চ্যানেলের মালিক যে দলের সমর্থক বা সক্রিয় নেতা সে চ্যানেলের সব প্রোগ্রাম ওই রাজনৈতক দলের মতাদর্শের অনুগামী হতে হবে। শিল্প-সংস্কৃতির জগতে এই বিভাজন আশঙ্কাজনকভাবে স্থবির করে দিয়েছে সৃজনশীলতাকে।
এদেশের গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা অনেক। ভারতের গণতন্ত্র কর্পোরেট পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়লেও ওদেশে এখনো খোলামেলা বা স্বাধীন মত প্রকাশের পরিসর অনেক বড়। তাই হায়দারের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের দেশে কি তা সম্ভব? কোনো সৃজনশীল নির্মাতার পক্ষে এ ঝুঁকি নেওয়া কঠিন।
বিভিন্ন বাহিনী যেভাবে সাধারণ মানুষের প্রায় গায়ে গায়ে লেগে আছে তাতে অনেক ঘটনারই অন্তরালের আসল কারণ নিয়ে কাহিনী নির্মাণ করা বেশ কঠিন কাজ। এও এখানকার এক বড় বাস্তবতা। সৃজনশীলতা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা।
রাজনীতিবিদরা পথ হারালে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষের দায় বেড়ে যায়। যদিও সুস্থ রাজনীতির বিকাশ ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব নয়। তবুও গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব সাংস্কৃতিক কর্মকা- বাড়ানো প্রয়োজন।
রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পোলারাইজেশনের দীর্ঘায়নে সমাজের ভেতরে এমন কিছু উপাদান জমা হয়েছে যা নীরবে ভেঙ্গেছে সবকিছু। ভাঙন বা বদলটা হুট করে চোখে পড়ে না। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ যারা করেন তারা বলেন, পুরনো সমাজ থেকে নতুন সমাজ মৌলিকভাবে পৃথক। তবে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার কারণে পূর্বতন সমাজের সঙ্গে নতুন সমাজটি সম্পর্কিত থাকে। একই সময়ে এ দুটি পরস্পর পৃথক আবার পরস্পর সংযুক্ত।
পুরনো সমাজ ভেঙ্গেই নতুন সমাজ গড়ে ওঠে বলে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকার ব্যাপারটা সচরাচর বেশি গুরুত্ব পায়। উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। নতুন সমাজের ভ্রƒণটি জন্ম নেয় পুরনো সমাজের গর্ভে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভ্রƒণটি বিকশিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে পরিণত হওয়ার সঙ্গে জননীর মৃত্যু সরাসরি সম্পর্কিত। মানুষের জন্ম ও বৃদ্ধির সঙ্গে সমাজের জন্ম ও বিকাশের বেশ অমিল রয়েছে। সমাজ ব্যবস্থার মৃত্যুর সঙ্গেও মানুষের মৃত্যুর পুরোপুরি তুলনা চলে না।
কোনো ব্যক্তি মারা গেলে মৃতদেহটি দ্রুত কবরস্থ করা, মাটির নিচে একেবারে পুঁতে ফেলা কিংবা চিতার আগুনে ভস্মীভূত করা সম্ভব। কিন্তু কোনো সমাজ ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটলে তেমনটি করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মৃত সমাজদেহটি আমাদের সকলের মাঝখানে উন্মুক্ত থাকে এবং ধীরে ধীরে পচতে থাকে।
সেই পচা-গলা সমাজদেহটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পূর্ব পর্যন্ত আবহাওয়াকে দূষিত করে এবং প্রতিনিয়ত আমাদের অর্থাৎ নতুন সমাজ ব্যবস্থার সব কিছুকে সংক্রমিত ও রোগাক্রান্ত করে।... নতুন সমাজ সাবালক হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত এ সমাজের সর্বত্র পূর্বতন সমাজের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাপ বজায় থাকে অর্থনৈতিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিগত সমস্ত দিক থেকেই। আর বজায় থাকে মুমূর্ষু পুরনো সমাজ আর বর্ধিষ্ণু নতুন সমাজের মধ্যে মরণপণ সংগ্রাম।
‘ইন্ডিয়া টুডে’ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। উপমহাদেশের পারিবারিক রাজনীতির ধারার সবশেষ যে উত্তরাধিকারীদের তালিকা পত্রিকাটি করেছিল তাদের কেউ কেউ আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত। আধুনিক জীবন ধারায় নির্মিত মানুষ। কিন্তু তাদের পরিচয় পারিবারিক উত্তরাধিকারে ভর করে এবং অপরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনৈতিক পটভূমিতে।
সময় ও সমাজ যদি ভেতরে ভেতরে সত্যিই না বদলায় তাহলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও এ তরুণরা কতখানি এগোতে পারবেন সে প্রশ্ন থেকে যায়। সে অর্থে নেতা বা হিরো, যার ডাকে এক হবে মানুষ, নির্ভরযোগ্য জীবনদর্শন নিয়ে এগোবে- সে রকম হিরোর শূন্যস্থান পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
নতুন শক্তিতে জাগছে তারুণ্য কিন্তু পরিবর্তনের তেমন কোনো মহান দর্শন কিংবা নেতৃত্ব দৃশ্যমান নয়। অনিশ্চয়তায় পথ হাতড়াবে কি তারুণ্যের সম্ভাবনা?
ব্যক্তিকে শুদ্ধ করে সমাজে শৃঙ্খলা ফেরাতে চেয়েছিলেন যারা, যারা বলেছিলেন আগে আদর্শ মানুষ হবে তারপর আদর্শ সমাজ তারা ইউটোপীয় হিসেবেই সমাজ-ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন। একজন করে ব্যক্তিসুদ্ধি করা যায় না। প্রয়োজন বলিষ্ঠ মতাদর্শ এবং নেতৃত্ব। গত শতকে সমাজ বদলের আন্দোলনে অনেক শক্তিশালী নেতৃত্ব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছিল। তখন তরুণদের সামনে মতাদর্শভিত্তিক পথপ্রদর্শক ছিল।
পরিপূর্ণ জীবনবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ ছিল। বিরোধিতার জায়গা ছিল। সুনির্দিষ্ট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ার সুযোগ ছিল। আজকের তারুণ্যের সামনে ওরকম জীবনদর্শন বা আদর্শ নেই বললেই চলে।
অমিত সম্ভাবনা নিয়ে তারুণ্যের লিডারশিপ অথবা হিরোর অভাবে ভোগা নিয়ে ইন্ডিয়া টুডে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের উজ্জ্বল সম্ভাবনার খবর দিয়েছিল বেশ ক’বছর আগে। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিশোধনের কথা বলেছিল।
বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা নেপাল এ পাঁচ দেশের পারিবারিক রাজনীতির সর্বশেষ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মূল্যায়ন করেছিল ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন। বাংলাদেশে আজ যে তরুণ সমাজ জেগেছে তারা পারিবারিক উত্তরাধিকার বহন করে না। সেদিক থেকে এ জাগরণ ব্যতিক্রম।