বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষার ভাবনা ও শিক্ষা সম্পর্কে ভাবনা তাঁর সামগ্রিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষা ও মানবসম্পদ একে অপরের পরিপূরক। শিক্ষার সঙ্গে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন শিশু-কিশোরদের মনে মূল্যবোধের সৃষ্টি ও তাদের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং মৌলিক চিন্তার অবকাশ খুব কমই ছিল। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত দেশের স্বপ্ন দেখেছেন। সেই স্বপ্নে এদেশের মানুষকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে ২৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের মূল উপাদানগুলো ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক। ১৯৭২ সালে এগুলো বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বাংলাদেশের সংবিধানেও উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি, চিন্তা বা দর্শন শিক্ষার মূলে রয়েছে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ। তাঁর শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে একটি অন্তর্দৃষ্টি পেতে আমাদের বাংলাদেশের সংবিধান, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, অসংখ্য অনুষ্ঠানে তাঁর ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রকাশিত বই কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ অসংখ্য দলিলপত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সবসময় সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়াররূপে দেখতে চেয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজে দ্রুত সামাজিক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য শিক্ষাকে বিশেষ হাতিয়াররূপে প্রয়োগ করতে হবে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির স্বার্থে সকল নাগরিকের মধ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষা লাভের সুযোগ-সুবিধার সমতা বিধানের মাধ্যমে জাতীয় প্রতিভার সদ্ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে।
নানাবিধ কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অনাচার ও দুর্নীতি অবসানের অনুকূল বিজ্ঞানমুখী, আদর্শবাদী ও সামাজিক উন্নয়নের পরিপোষক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। এজন্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম মান পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বিভিন্ন ভাষণে প্রয়োগমুখী অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূল শিক্ষার কথা বলেছেন। দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নতির উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিশাল দায়িত্ব শিক্ষা ব্যবস্থার।
বঙ্গবন্ধু যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশ বিধ্বস্ত ছিল একটি দেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সাহসী হৃদয় এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারাবাহিকতায় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ পেশ করেন। এই নীতিসমূহ প্রায়োগিক পর্যায়ে রয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ মানে খাঁটি মানুষ দরকার। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর পুনর্গঠন কর্মসূচির জন্য শিক্ষিত কর্মীবাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন। তাই প্রথম থেকেই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার বিধানসহ গণমুখী, অভিন্ন, প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যুগ যুগের উন্নত জ্ঞান ও সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে একটি প্রগতিশীল ও আলোকিত জাতি গড়তে চেয়েছেন, যা তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে। সেই লক্ষ্যে যুগোপযোগী, গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. খুদরত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে ১৯৭২ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।
কমিশনকে নতুন জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুসারে এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও প্রাসঙ্গিক সাংবিধানিক বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কমিশন ৩০ মে, ১৯৭৪ তারিখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনে একটি প্রগতিশীল, আধুনিক, গণমুখী, অভিন্ন এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের সমস্ত উপাদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু একজন দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তাই তিনি এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার কল্পনা করেছিলেন, যা জাতির সম্ভাবনাকে উন্মোচন করে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে। যার ফলে দেশের দ্রুত পুনর্গঠন ও উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে নিরক্ষরতা দূরীকরণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য কারিগরি জনবলের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে কারিগরি শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেন। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় খাদ্য অর্জনের জন্য জ্ঞানের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য ছাত্রদের কৃষি শিক্ষা, গবেষণা এবং বাস্তব প্রশিক্ষণের ওপরও জোর দেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে তাঁর একটি বক্তৃতায় শিক্ষা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি ভালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। তাঁর ভাষণে শিক্ষাকে সর্বোত্তম বিনিয়োগ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সকল স্তরের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। নতুন মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রবেশাধিকার এবং চিকিৎসা শিক্ষাসহ কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণের ওপরও জোর দেন।
উচ্চশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, দরিদ্রতা যেন শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার প্রতিবন্ধক না হয়। তিনি জিডিপির ৪% শিক্ষার জন্য বরাদ্দের দাবি করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অবাধ জ্ঞান ও গবেষণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে একটি মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন যাতে এটি গবেষণা, অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ এবং বিশ্লেষণাত্মক বিতর্কের মাধ্যমে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জ্ঞানের জন্ম দেয়, যা বাধাহীন এবং বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া চলতে পারে। অবাধ একাডেমিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আদেশ জারি করে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেন।
তিনি স্থানীয় সমস্যার দেশীয় সমাধান এবং স্থানীয় প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে ফলিত গবেষণার ওপর জোর দেন। বঙ্গবন্ধু একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদান বরাদ্দ এবং পর্যবেক্ষণের জন্য উচ্চশিক্ষার সুবিধার্থে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন। এই সংস্থাটিকে উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ববদ্যিালয় মঞ্জুরি কমিশন এরই ধারাবাহিকতায় সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করছেন। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জনের মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ নথিভুক্তি, উপবৃত্তি, ফিডিং প্রোগ্রামের মতো বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে ঝরে পড়ার হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা, নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ। যার ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পুরুষ শিক্ষার্থীর চেয়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক নতুন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
আইসিটি শিক্ষা এবং আইসিটি অবকাঠামোর উন্নয়ন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া বাংলাদেশে অনন্য অগ্রগতি করেছে। বঙ্গবন্ধু প্রায় ৩০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে প্রায় এক লাখ প্রাথমিক শিক্ষক সরকারি কর্মচারী হিসেবে আত্মীকৃত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমূল সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হোক।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি করা সম্ভব নয়। তাঁর ভাষায়- ‘শিক্ষা হচ্ছে বড় অস্ত্র, যা যে কোনো দেশকে বদলে দিতে পারে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলতেন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরের মতো প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন দেশ শুধু মানবসম্পদ সৃষ্টি করে যদি উন্নত দেশ হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশও একদিন উন্নত দেশ হবে। আর সেজন্যই তিনি নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর সেসব উদ্যোগের কিছু ছিল তাৎক্ষণিক আর কিছু ছিল দীর্ঘমেয়াদি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ সালের শিক্ষানীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার ব্যাপক প্রতিফলন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার দেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৪১, স্মার্ট বাংলাদেশ এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ ঘোষণা করেছেন। প্রত্যেকটি ভিশন সফলভাবে বাস্তবায়নে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা জাতিকে পথ দেখাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু নৈতিক শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন।
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরকেন্দ্রিক তিন স্তরবিশিষ্ট। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় ৫ বছরমেয়াদি প্রাথমিক, ৭ বছরমেয়াদি মাধ্যমিক। এর মধ্যে ৩ বছরমেয়াদি জুনিয়র, ২ বছরমেয়াদি মাধ্যমিক এবং ২ বছরমেয়াদি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ৩-৫ বছরমেয়াদি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ৫৮টি পাবলিক ও ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তত্ত্বাবধানে অধিভুক্ত কলেজের মাধ্যমে এ শিক্ষা দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বা ইংরেজির মধ্যে যে কোনোটিকে বেছে নিতে পারে। সরকার বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স (ব্যানবেইজ) গঠন করেছে, যা সব পর্যায়ের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট তথ্য সংরক্ষণ করে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে বৈশ্বিক চাকরির বাজার দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্তমানের অনেক পেশাই যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি অনেক নতুন পেশা সৃষ্টি হবে, যা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। এছাড়াও কোভিড-১৯ মহামারি পৃথিবীর প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোকে চ্যালেঞ্জে ফেলায় মানুষের অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এমন এক অনিশ্চয়তার পৃথিবীর জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করতে হলে শিক্ষককেন্দ্রিক, পাঠ্যবই মুখস্থনির্ভর এবং লিখিত পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুতেই কার্যকরী নয়।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াটি হলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী যে কোনো যোগ্যতা অর্জন করতে হলে তা চারপাশের বিভিন্ন ব্যক্তি (সহপাঠী, অভিভাবক, শিক্ষক, এলাকার লোকজন) ও উৎস (পাঠ্যবই, অন্যান্য বই, ওয়েবসাইট, প্রকৃতি, সামাজিক পরিবেশ) থেকে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করবে এবং তা আলোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করবে। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে থাকছে না কোনো প্রতিযোগিতামূলক নম্বর বা জিপিএভিত্তিক শিখন যাচাই প্রক্রিয়া। পরীক্ষাকেন্দ্রিক সনদের পরিবর্তে পারদর্শিতার সনদের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর দক্ষতা, মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির কী পরিবর্তন হলো সেটি সামষ্টিকভাবে পরিমাপের নির্দেশক নির্ধারণ করা হয়েছে। অভিভাবক ও সমাজের সম্পৃক্ততার সুযোগ রাখা হয়েছে।
প্রতিটি শিক্ষার্থীরই একটা পর্যায় পর্যন্ত বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের যোগ্যতা অর্জন করা প্রয়োজন। প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা সমন্বিতভাবে সামাজিক বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিজ্ঞান একটি সমন্বিত বিষয় হিসেবে পড়লেও স্বাভাবিক কারণেই এই বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্ব পেত না। নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বিভাগের বিভাজন না থাকলেও অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের গুরুত্ব অন্য বিষয়গুলোর তুলনায় বেশি রাখা হয়েছে, যাতে সমন্বিত বিষয় হিসেবে থাকলেও এই বিষয়গুলো অধিক গুরুত্ব পায় এবং সেই অনুযায়ী শিখন সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আবার একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে সাধারণ বিষয়সমূহ, যেমন- বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি শিক্ষায় এখন যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, বিষয়গুলোর ধরন পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন রূপরেখায় তার গুরুত্ব ও সংশ্লিষ্ট শিখন সময় অনেকখানি কমিয়ে আনা হয়েছে, যাতে এর পরিবর্তে বিশেষায়িত বিষয়সমূহের ওপর এই স্তরে জোর দেওয়া হয়।
এই শিক্ষাক্রমে সকল ধরনের শিক্ষার্থীর সবলতা ও চাহিদা পূরণের জন্য ইনক্লুশনের অ্যাপ্রোচটি শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। পার্সনালাইজড শিখনের মাধ্যমে জেন্ডার, ধর্ম, বর্ণ, প্রতিবন্ধিতা, সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে শিশুর সামর্থ্য, চাহিদা ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তার শিখন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। শিক্ষাক্রমে নমনীয়তা বজায় রাখার ফলে প্রতিবন্ধী, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজ্যাবিলিটি আছে এমন এবং পিছিয়ে পড়া শিশুদের প্রবেশগম্যতা, অংশগ্রহণ ও অর্জন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে অতিমেধাবী শিশুদের শিখনচাহিদা ও সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে তার উপযোগী শিখন কার্যক্রমের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতে এসেছে নতুন ধারণা।
শিক্ষাক্রমটি রাতারাতি বাস্তবায়ন হবে না। এটি ২০২১ সাল থেকে পাইলটিং শুরু হয়, যা ২০২৭ সালে গিয়ে পূর্ণ বাস্তবায়নের পর্যায়ে যাবে। ধাপে ধাপে পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তনগুলো আনার প্রয়োজন পড়বে তার প্রস্তুতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এভাবে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এমনকি ২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পরীক্ষামূলক সংস্করণ হিসেবে সারাদেশে বই বিতরণ করা হয়েছে, যাতে করে বই কিংবা প্রক্রিয়াতে কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধনের সুযোগ থাকে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে হাইব্রিড কৌশল আনার পর শিক্ষকরা অনলাইনে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরে মুখোমুখি প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন এবং এরপরে উপজেলাভিত্তিক অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মেন্টরিং গ্রুপের মাধ্যমে স্কুলে বাস্তবায়নের সময় বছরব্যাপী সহযোগিতা পাবেন।
শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, আন্তঃমন্ত্রণালয় কাজের সমন্বয় এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অনেকটা সাফল্য নির্ভর করছে। শিক্ষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে মেধাবীদের এই পেশায় নিয়ে আসতে হবে। আবার ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য ভবিষ্যৎমুখী বাস্তবায়ন দলও প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্থানীয় ও স্কুল পর্যায়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন না হয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এই নতুন পদ্ধতির সুফল পেতে হলে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামো ও ডিজিটাল কানেকটিভিটিসহ সার্বিক উন্নয়নে আগের তুলনায় আজকের বাংলাদেশ বদলে গেছে। ১৪ বছর আগের এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের দিকে তাকালে সেই সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা যায়। শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসের রাজত্ব দেখা গেছে।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার অথবা কোটাবিরোধী আন্দোলনে দুষ্কৃতকারীদের সরকারি স্থাপনায় হামলার মাধ্যমে দেশ ধ্বংসের ব্যর্থ পরিকল্পনাই প্রকাশ পেয়েছে। কোটা সংস্কার করে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছে। তাই এখন সকল পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও শৃঙ্খলা কার্যকর করা।
বঙ্গবন্ধু হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে। আমাদের আগামী শিক্ষিত প্রজন্ম মেধায়-মননে, প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করি।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, সাবেক উপাচার্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট