ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দুর্নীতি প্রতিরোধে চাই সামাজিক সচেতনতা

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ৩১ জুলাই ২০২৪

দুর্নীতি প্রতিরোধে চাই সামাজিক সচেতনতা

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

দুর্নীতি এখন সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি প্রতিটি সমাজ ও দেশের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। বিভিন্ন সমাজ-দেশে দুর্নীতির কারণ, ধরন ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। দুর্নীতি অনেক রূপে ঘটতে পারে। অনেকেই দুর্নীতি বলতে শুধু অবৈধ বা অনৈতিক আর্থিক লেনদেনকে বোঝে। কিন্তু যা কিছু নীতির পরিপন্থি বা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা-ই দুর্নীতি। নিজে সুবিধা না নিয়েও নিকটজনকে অপ্রাপ্য বা অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, যোগ্যজনকে তার ন্যায্য সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করাও গুরুতর দুর্নীতি।

নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করাও বড় ধরনের দুর্নীতি। কারও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতি। দুর্নীতির এই রূপটি দুর্নীতির অপসংস্কৃতি লালন এবং সমাজকে ভেতর থেকে ক্ষয় করার জন্য দায়ী।
বিপুল জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ, সুশিক্ষার অভাব, নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মানসিকতা, দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং দুর্বল, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থার কারণে দুর্নীতি বাংলাদেশেও একটি ভয়াবহ সমস্যা। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতির অস্তিত্ব রয়েছে।

রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে শুরু করে পারিবারিক স্তর, এমনকি ব্যক্তি জীবনেও ঢুকে পড়েছে দুর্নীতি। নানা কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পরিবার ও সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতার খবর শুনতে পাই। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশে এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। তবে একদিনে দুর্নীতি এ অবস্থানে আসেনি। স্বাধীনতার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ দুটি সামরিক স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছে।

যেখানে ক্ষমতাই ছিল সবকিছু। তখন তারা দেশবাসীর সামনে এমন একটি অবিচার-অনাচারপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যেখানে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা যায়। গণমাধ্যমে সে কথা সগর্বে প্রচারও করা যায়। খুনিদের স্বীকারোক্তির পরও তাদের বিচার করা যায় না। প্রয়োজনে আইনি বিচার ঠেকাতে সংবিধান সংশোধন করা যায়। কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দিয়ে খুনিদের পুরস্কৃত করা যায়। এমনকি খুনিরা রাজনৈতিক দলও খুলতে পারে। অর্থাৎ ক্ষমতাবানদের ইচ্ছাই হলো সব। আইন-আদালত-সংবিধান কোনো ব্যাপারই না।
ক্রমান্বয়ে এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে বিশাল মহীরুহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যার শিকড় বহু গভীরে বিস্তৃত হয়ে দৃঢ়তা লাভ করে। এ অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিলেনে এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী নেতৃত্ব দিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। বিগত কয়েক বছর, বিশেষ করে গত এক দশকে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাস এবং উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য আখ্যান রচনা করেছে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুততম উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। চলমান উন্নয়ন ও অগ্রগতি টেকসই করার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতিকে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
দুর্নীতি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট নয়। দুর্নীতি দেশের সব অর্জন এবং জাতীয় উন্নয়নের সব প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিতে পারে। এ কালব্যাধির করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠতে পারে অনিশ্চিত। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্নীতির কালো হাত নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। বস্তুত এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যেখানে অবস্থান করছে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা গেলে অতিদ্রুত সেই অবস্থান আরও অনেক ওপরে উঠে যাবে, এতে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ তথা সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ বিকাশের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সামাজিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব জাগ্রত না হলে কেবল দুর্নীতি দমন কমিশনের একার পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। বর্তমান সমাজে দুর্নীতির অবস্থান এতটাই শক্তিশালী যে, দুর্নীতি দমন কমিশনে দুর্নীতিসংক্রান্ত হাজার হাজার মামলা ঝুলে আছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। চলতি মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কার এবং দেশ পরিচালনায় কিছু ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেনÑ এর মধ্যে অন্যতম হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’। দুর্নীতি দমন করে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সকল সুযোগ এবং সম্ভাবনার সকল দ্বার উন্মোচিত করতে শেখ হাসিনার সরকার বদ্ধপরিকর। 
দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থানে আগে থেকেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন উদ্যোগ, কঠোর আইনকানুন, কৌশল প্রণয়ন করেছেন মাঠ পর্যায়ে দুর্নীতি দমনের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বেশ কয়েকবার দেশজুড়ে চলেছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। ছাড় দেওয়া হয়নি প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকে। দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা।

প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ দেশের গণমানুষ ও সুশীল সমাজের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মতে, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন খুবই জরুরি। তবে এই কঠিন লক্ষ্যে সাফল্য অর্জনে শুধু কঠোর আইন ও প্রবিধান প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, একই সঙ্গে প্রয়োজন দুর্নীতি সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা। কাজেই সর্বস্তরে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতেই হবে। এ ছাড়া দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়।

লেখক :  বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

×