ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

‘স্বাধীনতা পদক’ প্রাপ্ত কাজী আলমগীর সাত্তার

কাজী সেলিম

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২ এপ্রিল ২০২৪

‘স্বাধীনতা পদক’ প্রাপ্ত কাজী আলমগীর সাত্তার

কাজী আলমগীর সাত্তার

সরকার ২০২৪-এর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পরস্কার প্রদান  করেছে। যাদের মধ্যে অন্যতম কাজী আলমগীর সাত্তার, ’৭১-এর বীর বৈমানিক আকাশযোদ্ধা বীর প্রতীক তিনি। ২৫ মার্চ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পুরস্কারটি গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে।
কাজী আলমগীর সাত্তার (বীর প্রতীক) ভাই তার পেশাগত কঠিন জীবন পছন্দ করে নিয়েছিলেন। একজন নির্ভীক বেসামরিক বৈমানিক হিসেবে ১৯৬০-এর দশকের দিকে তদানীন্তন পিআইএ-তে যোগদান করে নিজেকে একজন পেশাদার, দক্ষ পাইলট হিসেবে প্রস্তুত করতে কঠোর অধ্যাবসায়, প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।

তিনি যখন একজন পূর্ণাঙ্গ যাত্রীবাহী বিমানের বৈমানিক বা পাইলট হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেন, তখনকার তৈরি বিমানসমূহ আকাশপথে বিশে^র একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে সাগর মহাসাগর পাহাড় পর্বত দুর্গম ঝড়ঝঞ্জা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার অর্থাৎ, প্রায় ৩১ হাজার থেকে কখনো ৪২ হাজার ফুট উচ্চতায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো চলাচল করত। বিমানসমূহ তখন হস্তচালিত হতো গধহঁধষ উবারপব যন্ত্রপাতির সাহায্যে।

এ ধরনের যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিমান পরিচালনার কাজগুলো পরিচালিত হতো মানসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সদাসতর্কভাবে কঠিন মনোযোগে নিজেকে ও অপরসহযোগী বৈমানিক পাইলটদের, স্ব স্ব মস্তিষ্ক, দৃষ্টি, মনোনিবেশ এবং যাত্রী ও বিমানকে নিরাপদে গন্তব্য স্থলে নিয়ে যাওয়া। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলমগীর সাত্তার ভাই ষাট পেশাগত বৈমানিক কর্মজীবনকে দক্ষ, সচেতন পেশাদার বৈমানিক বা পাইলট হিসেবে সম্মান ও সুনামের সঙ্গে নিজের কর্মময় জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি, নিজেকে সর্বস্তরের মানুষের নিকট একজন খুরধার লেখক হিসেবেও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তার লেখা ও প্রকাশিত অন্যতম দুটি বই, পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরাচার একনায়ক আইউবের ওপর লিখিত ‘আয়ুব খানের কুমির শিকার’ এবং ’৭১ এ নরঘাতক, লম্পট ইয়াহিয়া খানের ওপর লিখিত রসাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক বই। গল্পগুলো বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল পাঠকদের নিকট।

এবারের একুশের বই মেলায়ও তার লিখিত ’৭১-এর মহান মুক্তি সংগ্রামে সরসরি অংশগ্রহণের ওপর ‘কিলো ফ্লাইট’ বইটিও পাঠকদের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একজন সদা ব্যস্ত পেশাদার দায়িত্বপূর্ণ বিমান পরিচালনার ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ঘরে ফিরে, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি হরেক রকমের লেখায় নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
২৬ মার্চ, ১৯৭১-এর কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনী যখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিকট শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার এক ভয়াবহ গণহত্যায় লিপ্ত হয়, ঠিক তখনই কাজী আলমগীর সাত্তার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক আহ্বানে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ সেথা শির’ অথবা ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’ এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশমাতৃকার মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি যোগদানের এক সুকঠিন দৃঢ় সংকল্প ও চেতনা নিয়ে বিপদ, শঙ্কা, ভয়ভীতি বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে, ঢাকা ত্যাগ করে প্রথমে কালকিনির দক্ষিণ গোপালপুরস্থ স্বীয় বাড়িতে সংক্ষিপ্ত সময় অতিবাহিত করে স্ত্রী, সন্তান, বৃদ্ধ মা, ভাইবোনদের রেখে এক অচেনা বন্ধুর কণ্টকিত পথ অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় পৌঁছে, পিআই-এর কর্মরত সহকর্মীদের সমবেত একত্রিত করে অগ্রসর হয়েছিলেন মহান মুক্তি সংগ্রামের এক অকুতোভয় সংগ্রামী বৈমানিক যোদ্ধা হিসেবে। 
ভারতের মাটিতে অবতরণ করার পরই মহান মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক ও বাঙালি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি বৈমানিকদের সম্মিলিত অথবা পৃথক ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও পরিকল্পনা নির্ধারণের লক্ষ্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী অফিসার এম কে বাশার, এ কে খন্দকার, সুলতান মাহমুদসহ কতিপয় দক্ষ, সাহসী পেশাগত পাইলটদের সমন্বয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রদেশ নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল একটিই, আর নয় ঘাতক পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন শোষণ।

হানাদার পাক বাহিনীর সংগঠিত বর্বর গণহত্যার চরম ও কঠিন প্রতিশোধের এক দৃঢ় কঠিন সমন্বিত পরিকল্পনা ‘বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত’ এই মহান ব্রত নিয়ে আপোসহীন দৃঢ় মনোবল ও চেতনায় বলীয়ান হয়ে, দ্রুত কাজ শুরু করেন কাজী আলমগীর সাত্তার, নবগঠিত বাংলাদেশে বিমান বাহিনীর একজন বীর আকাশযোদ্ধা হিসেবে।

পুরাতন মডেলের ডাকোটা বিমানকে ছোট ছোট কামানে সুসজ্জিত করে শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে আঘাত হানার পদ্ধতি ও পারিকল্পনার ওপর বিশেষ বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে, বিমান বাহিনীর বাঙালি পাইলটদের সঙ্গে একত্রিত সমন্বিতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হানাদার পাক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ওপর আঘাত করে পাক বাহিনীর ঘাতকদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছিলেন। গোপালপুর, কালকিনি তথা মাদারীপুরের জনগণ স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাব ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পাওয়ায় ’৭১-এর বীর বিমান যোদ্ধা কাজী আলমগীর সাত্তার ভাইকে জানায় সংগ্রামী অভিনন্দন, সালাম ও রক্তিম শুভেচ্ছা।

 লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা

×