ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

সরকারের উন্নয়ন মডেল

​​​​​​​ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২২:২১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সরকারের উন্নয়ন মডেল

.

ইতোমধ্যে স্পিকারের সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের প্রথম সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছে। উক্ত অধিবেশনে গত ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জ- আসনের সংসদ সদস্য চয়ন ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার এখন কাজ করছে এবং স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণই এই সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য। বর্তমান সরকার রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপ দিতেইরূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১হাতে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের লক্ষ্যে ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি স্মার্ট সমাজ- এই চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে টেকসই ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রসারের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে বাংলাদেশকে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত, সমৃদ্ধিশালী দারিদ্র্যশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত করা।

সংসদ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৩) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে মধ্য দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব পরিকল্পনা গ্রহণ বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।  শেখ হাসিনা বলেন, রূপকল্প ২০২১ সামনে রেখে দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবেবাংলাদেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১)’ প্রণয়ন করা হয়েছিল। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা। এই ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে সরকার মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) গ্রহণ সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে ২০১৫ সালের জুলাই বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে গড়ে দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি, মৎস্য, শিল্প, বনায়ন, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ প্রতিবেশ প্রভৃতি বিবেচনায় নিয়ে একটি সমন্বিত শতবর্ষী মহাপরিকল্পনাবাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০প্রণয়ন করেছে। অব্যাহত উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশজ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন অনুমোদন  দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই পরিকল্পনা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই পরিকল্পনার রূপকল্প হচ্ছে নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলা। রূপকল্প-২০২১-এর পর রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নেবাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১গ্রহণ করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পরিকল্পনার ভিত্তিমূলে রয়েছে দুটি প্রধান অভীষ্ট-২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা, যেখানে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি এবং বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। এই প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ধারাবাহিক চারটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে, যার প্রথমটি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। পরিকল্পনা প্রণয়নে রূপকল্প-২০৪১-এর পাশাপাশি বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর মূল লক্ষ্যসমূহ, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি), চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সংসদ নেতা বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিষয়টি মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে জিইডি নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২৬-২০৩০) প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

সদ্যসমাপ্ত জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত ২৭ ডিসেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা করেন দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশর শেখ হাসিনা। যেখানে স্লোগান দেওয়া হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান। এবারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যস্মার্ট বাংলাদেশ।চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও চলমান কার্যক্রম ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ২০২৮ সালের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭১ বিলিয়ন ডলার, মুদ্রাস্ফীতি শতাংশে নামিয়ে আনা, জিডিপির প্রবৃদ্ধি দশমিক শতাংশে উন্নীত করা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশে উন্নীত, প্রবাসী আয় ১৪ শতাংশে বৃদ্ধি, ২০৩১ সালের মধ্যে হতদরিদ্রের অবসান, ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষ প্রায় ১৯ কোটি সিম এবং ১০ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নির্মাণ করা হয়েছে হাজার ৯২৮টি ওয়ানস্টপ সেন্টার, ৫২ হাজার ২০০টি সরকারি ওয়েবসাইট। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রাবন্দর নির্মাণ, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর এলএনজি টার্মিনালের মতো মেগা প্রকল্প নির্মাণ করে বাংলাদেশ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা ম্যাস ্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (এমআরটি), ঢাকা-চট্টগ্রাম আট লেন এবং দেশের সব মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। গ্রামকে নগরের সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা শিশুকল্যাণ, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ মাদক নির্মূল করা, গণতন্ত্র আইনের শাসন সুদৃঢ়করণ, সর্বস্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, দক্ষ সেবামূলক জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠা, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলা, ব্লু-ইকোনমি সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন, প্রবীণ প্রতিবন্ধী-অটিজম কল্যাণ, টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, ভূমি গৃহহীন লাখ ৪৭ হাজার ৭১৪টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী অনেক কোম্পানি উৎপাদন শুরু করেছে। পুরো প্রকল্প চালু হলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। আগামী পাঁচ বছরে সরকার ঘোষিত দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থানে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

গত ১৫ বছরে বদলে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক সব সূচক। যেমন মাথাপিছু আয়, বাজেটের আকার, জিডিপির আকার, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, রপ্তানি আয়, দারিদ্র্যের হার অতি দারিদ্র্যের হার কমা, স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি ইত্যাদি। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট কেবিনেট প্রয়োজন। তাই মন্ত্রিসভায় নতুন মন্ত্রীর সমাহার চোখে পড়ার মতো। এরই মধ্যে কয়েকটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনী ইশতেহার বর্ণিত ১১টি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর। তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা, যার অংশ হিসেবে প্রথমেই তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে দিকনির্দেশনা দেবেন। একইভাবে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঠিক করতে নির্দেশনা এসেছে এবং সে মাফিক নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী একশন নিতে শুরু করেছেন, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি গণমাধ্যমে। বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে। এই উত্তরণ একদিকে সম্মান, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জেরও বটে। জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা রয়েছে। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে এদেশের যা কিছু মহৎ অর্জন তা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধস্মার্ট সোনার বাংলাপ্রতিষ্ঠিত হবে- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

×