ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

হুমকিতে পর্যটননির্ভর দেশ মালদ্বীপ

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

হুমকিতে পর্যটননির্ভর দেশ মালদ্বীপ

মালদ্বীপে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. নাজমুল হাসানের সঙ্গে লেখক ও ড. আফজাল হোসেন

বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম রাষ্ট্র মালদ্বীপের মোট আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রের ওপরে ১১৯২টি ক্ষুদ্র  দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই রাষ্ট্র। এর মধ্যে রয়েছে কিছু পাবলিক দ্বীপ আর কিছু প্রাইভেট দ্বীপ। পাবলিক দ্বীপগুলোতে ট্যুরিস্টদের পাশাপাশি মালদ্বীপের স্থানীয়রা বসবাস করেন। প্রাইভেট দ্বীপগুলোর বিলাসবহুল রিসোর্ট ট্যুরিস্টদের টার্গেট করে তৈরি করা হয়েছে। মালদ্বীপের অর্থনীতি মূলত মিশ্র অর্থনীতি, যা পর্যটন এবং মাছ শিকারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। 
মালদ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো প্রাইভেট দ্বীপগুলোর যে কোনো একটিতে রাত যাপন। এমনই একটি  বিলাসবহুল ওভারওয়াটার রিসোর্ট হলো ‘মাফুশি রিসোর্ট’, যেখানে এক রাত থাকতে চাইলে গুনতে হবে প্রায় ১ লাখ টাকা। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের অসাধারণ ভিউ তো আছেই, সঙ্গে রয়েছে সমুদ্রের পানির অপরূপ সৌন্দর্য। পানিময় ভিলায় ঘুম থেকে ওঠা, আকাশি নীল জলে ঘেরা এবং প্যানোরামিক সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য কার না ভালো লাগে? কিন্তু টাকার অঙ্কের কথা মনে হলেই বেলুনের মতো চুপসে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। শুনেছি, এ ধরনের বিলাসবহুল রিসোর্টগুলোতে নাকি মুম্বাইয়ের নামী-দামী ফিল্মস্টারদের আনাগোনাই বেশি থাকে। 
ছোট্ট এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা মাত্র ৩ লাখ ৫০ হাজার, যার প্রায় শতভাগই মুসলমান। বিদেশীসহ এখানে প্রায় ৫ লাখ লোক বসবাস করেন, যার মধ্যে বাংলাদেশী প্রবাসী রয়েছে প্রায় ১ লাখ। আবহমানকাল ধরে দ্বীপবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস করছেন। পুরুষরা প্রধানত মৎস্যশিল্প ও ছুতার কাজে নিযুক্ত আর নারীরা পরিবার ও গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত থাকেন। তবে অনেক  নারী রয়েছেন যারা স্বাধীনচেতা এবং  উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।

বিধাতা যেন এ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে দুই হাত ভরে অপরূপ সাজে সাজিয়েছেন, যা দুনিয়াজোড়া মানুষকে মুগ্ধ করে এবং টানে। মালদ্বীপের মূল আকর্ষণ এর স্নিগ্ধ, সরল, শান্ত ও মনোরম পরিবেশ। সমুদ্রের রং অতি পরিষ্কার, পানির রং নীল, বালির রং সাদা। ছোট ছোট দ্বীপগুলো যেন নানা রঙের মাছের অ্যাকুরিয়াম। বিশাল জলরাশি, সমুদ্র গর্জন, নির্মল বায়ুপ্রবাহ পর্যটকদের অশান্ত মনকে শান্ত করে। হতাশাকে দূর করে উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে দেয়, আর মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় মনপ্রাণ। মালদ্বীপের স্বচ্ছ পানির নিচে রয়েছে এক ভিন্ন জগৎ। রঙিন প্রবাল প্রাচীর, কচ্ছপ, তিমি, হাঙ্গর ঘেরা সে জগতের অভিজ্ঞতা অন্যরকম রোমাঞ্চকর। রয়েছে ক্ষুদ্র প্রাণবন্ত রিফ মাছ, মোরেঈল, টুনাসহ শত শত প্রজাতির মাছের সমাহার। এদের সঙ্গে সামুদ্রিক কচ্ছপ, অক্টোপাস, গলদা চিংড়ি ও ডলফিনের মতো অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর বসবাস। 
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি  দ্বীপ দেশটিতে রয়েছে এক অজানা ঝুঁকিও। এটি বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার উঁচুতে অবস্থিত। দ্বীপ দেশটি এক সময়  সমুদ্রের অতল গহীনে তলিয়ে যেতে পারে, হারিয়ে যেতে পারে মানচিত্র থেকে, এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি শতাব্দীর যে কোনো সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়বে। আর তখনই ডুবে যেতে পারে পুরো মালদ্বীপ। এত অপরূপ সৌন্দর্যম-িত একটি দ্বীপ দেশ ডুবে যাবেÑ এ কথা কি ভাবা যায়? বিষয়টিকে  মাথায় রেখে নতুন পরিকল্পনা হিসেবে ভাসমান শহর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার।
মালদ্বীপকে সারাবছর এক ঋতুর দেশ বলা হয়। যদিও গ্রীষ্মম-লীয় মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবই প্রধান। গড় তাপমাত্রা ওপরে ৩১ আর নিচে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর প্রায় একই তাপমাত্রা। বেশ মনোরম আবহাওয়া। ঋতুর কারণে কাপড়চোপড়ের তেমন বৈচিত্র্য চোখে পড়েনি। তবে দ্বীপের অধিবাসীদের রং-চঙের পোশাক পরতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ থেকে বেড়ানোর জন্য এমন আকর্ষণীয় দ্বীপমালার তুলনা হয় না। বিশ্বের অনেক দেশের সমুদ্রসৈকত নানা কারণে পর্যটকদের টানে। আমাদের কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, ছেঁড়া দ্বীপ কিংবা কুয়াকাটা যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে আমরা সেগুলোর মার্কেটিং করতে পারিনি। বাংলাদেশে যে সকল বিদেশী কাজকর্ম উপলক্ষে আসেন, তারাই মূলত সমুদ্রসৈকতগুলো দেখতে আসেন। শুধু কক্সবাজার কিংবা ছেঁড়া দ্বীপ বেড়ানোর জন্য কজনই বা আর আসেন?
মালদ্বীপের রাজধানী মালে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট রাষ্ট্রের ছোট্ট রাজধানী হিসেবে পরিচিত। তবে  শহরটি সবসময় কোলাহলপূর্ণ থাকে। ঘনবসতির শহর, ছোট শহর, জায়গার সংকট আছে, রাস্তা সরু, তবু শৃঙ্খলা আছে। মানুষ নিয়ম মেনে চলে। শহরটি পরিচ্ছন্ন। মালে শহরে হাঁটি আর আমাদের ঢাকার জন্য কষ্ট বাড়তে থাকে মনে হয় মালদ্বীপ পারে, আমরা কবে পারব! আধুনিক ভবন, ঐতিহাসিক মসজিদ এবং রঙিন বাজার মালে শহরটির  মূল কেন্দ্র, যা ঐতিহ্য ও অগ্রগতির এক অনন্য মিশ্রণ। মালদ্বীপের রাজধানী মালের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত হয়েছে একমাত্র দ্বীপ হুলুমালে। দ্বীপটির রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যে কোনো দোকানে পণ্যের দাম জানতে চাইলে যদি কানে বাংলা কথা ভেসে আসে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শুধু হুলুমালে নয়, মালেসহ মালদ্বীপের যে কোনো দ্বীপেই দেখা মিলবে শত শত বাংলাদেশী কর্মীর।
সম্প্রতি মালদ্বীপ ভ্রমণকালে আমি ও আমার বন্ধু ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আফজাল হোসেন বাংলাদেশ হাইকমিশনার রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। তখনই জানতে পারি, সরকারি হিসাব অনুযায়ী মালদ্বীপে বৈধভাবে কাজ করছেন ৭০ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক। তারা  বিভিন্ন দোকান, মার্কেট, রিসোর্ট ও হোটেলে কাজ করছেন। এছাড়াও ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন আরও প্রায় ৩০ হাজারের মতো বাংলাদেশী। এসব শ্রমিকের মধ্যে যারা বৈধভাবে কাজ করছেন, তারা ভালো আছেন।

আবার যারা অবৈধ, তারা কিছুটা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। তবে অবৈধ বাংলাদেশী শ্রমিকদের মালদ্বীপ সরকারের মাধ্যমে নিয়মিত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান। দেখা যাচ্ছে, সে দেশে কাজ করে এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। অপরদিকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা হলো পাঁচ লাখ। অর্থাৎ দেশটিতে প্রতি পাঁচজনে একজন বাংলাদেশী বাস করছেন। বাংলাদেশী কর্মীদের গড় বেতন ২৫০ থেকে ৩০০ ডলার। এছাড়া থাকা ও খাওয়ার জন্য সামান্য ভাতা পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা তারা দেশে পাঠাতে পারেন।

কয়েকদিন দ্বীপে হাঁটতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ হোটেলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে, কেউ জুস বানায়, কেউ কেউ দোকানে বসে। মালদ্বীপই যেন তাদের ঘরবাড়ি। একজন প্রবাসী বাংলাদেশী বললেন, নামাজের সময় যদি মসজিদে যান, দেখবেন বেশিরভাগ মুসল্লি বাংলাদেশী। এক বাংলাদেশী রেস্তরাঁর মালিক বলছিলেন, হোটেলে দ্বীপের কাউন্সিলর এসে ময়লা দেখলে জরিমানা করেন। এজন্য আমরা হোটেল সবসময় পরিষ্কার রাখি। এমন আরও কত শত কথা যে তাদের সঙ্গে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। 
মালদ্বীপের শীর্ষ ধর্মীয় স্থানগুলো মধ্যে একটি হলো গ্র্যান্ড ফ্রাইডে মসজিদ, যা শুধু আধ্যাত্মিক অন্বেষণকারীদের কাছেই নয়, পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয়। এটি আধুনিক সাদা-মারবেল কাঠামোর জন্য বিখ্যাত। পর্যটকরা এর সৌন্দর্যে আকর্ষিত হন। মসজিদটিতে বিশাল বিশাল সোনার গম্বুজ রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘুরে দেখার উপযুক্ত সময়। ধর্মীয় স্থানে উপযুক্ত পোশাক পরিধান করে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে। মালদ্বীপে ঘুরতে যাওয়া মানে বাস্তব জীবনে স্বর্গে পা রাখার মতো। দ্বীপ দেশটির অসংখ্য হোটেল, আর রিসোর্ট জীবনের অর্থ যেন পাল্টে দেয়। দেখেছি, যিনি একবার মালদ্বীপে ঘুরে এসেছেন,  তিনি আবারও বেড়ানোর সুযোগ খুঁজেন। মাত্র ৫ লাখ অধিবাসী, প্রায় সবাই মুসলমান এবং প্রধান পেশা মাছ শিকার। 
মালদ্বীপ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের একটি দেশ। নির্জনতাই হলো এর মূল বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রসৈকতগুলোতে যে ভিড় আর মানুষের কোলাহল থাকে, তা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ মালদ্বীপে আসে নীরব প্রশান্তি অনুভব করতে। বিলাসবহুল প্রাইভেট রিসোর্টগুলোতে রাজধানী মালে থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে জলযান কিংবা সি-প্লেন পৌঁছে দেয় পর্যটকদের। প্রকৃতির এমন নিরিবিলি-নির্জন পরিবেশে মানুষ যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে। আত্মজিজ্ঞাসায় উন্মুখ হয়ে ওঠে। নিজেকে খুঁজে বেড়ায়। কোথা থেকে এলো আর কোথায় যাবেÑ তা যেন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের সুযোগ এমন নির্জন দ্বীপেই সম্ভব। অনেকেই বলে থাকেন, ‘সাইলেন্স ইজ এক্সপেন্সিভ’। তবে আমাদের কিন্তু তেমন ব্যয়বহুল মনে হয়নি। কারণ, এমন নির্জনতায় ডুবে থাকার জন্য এটুকু ব্যয় করাই যায়।

লেখক : চেয়ারম্যান, ব্যুরো বাংলাদেশ

×