
সম্পাদকীয়
স্বভাবকবি রাধাপদ সরকারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রামে। পরিবারটি নিতান্ত দরিদ্র ও অসহায়। বসবাস করেন জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার গোড্ডারাপাড়ার বটতলায়। বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষকে কবিতা ও গান শুনিয়ে জীবিকা নির্বাহ ও সংসার চালান। গত শনিবার তিনি বাড়ির পাশের ডুবরির ব্রিজের কাছে মাছ ধরতে গেলে পার্শ্ববর্তী গ্রামের দুই ভাই অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায় তার ওপর। মারধর করে গুরুতর আহত করে। পরে চিৎকার করলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আহত অবস্থায় বর্তমানে তিনি নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় রাধাপদ সরকারের ছেলে রবিবার রাতে থানায় মামলা দায়ের করেন নাগেশ্বরী থানায়।
হামলাকারীদের সঙ্গে স্বভাবকবির কোনো পূর্বশত্রুতা ছিল না। দেনা-পাওনার জন্য কয়েক মাস আগে রাধাপদ সরকারের সঙ্গে ছোট ভাইয়ের কথাকাটাকাটি হয়। এর জের ধরে দুই ভাই প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। সর্বশেষ ঘটে হামলার ঘটনা। বর্তমানে দুই ভাই পলাতক। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুই ভাইকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে, রাধাপদ সরকারের পরিবার ন্যায়বিচারের দাবি করেছে। তবে ঘটনার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি-না তা তদন্ত করে খুঁজে বের করতে হবে থানা-পুলিশকে। কেননা, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই এ রকম উস্কানিমূলক ঘটনা ঘটছে। হামলার শিকার হচ্ছে নিরীহ স্বভাবকবি, বাউলশিল্পী, লোকশিল্পীসহ বিভিন্ন সংস্কৃতি কর্মীরা, যারা নিতান্তই নিরীহ অসহায় ও চারণ স্বভাবের। এসব ব্যক্তি বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতির ধারকও বটে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিকভাবে বাউল ও লোকশিল্পীদের ওপর হামলাসহ এসব ঘটনা কি ঘটতেই থাকবে? এসব হামলা প্রকারান্তরে বাঙালি সংস্কৃতির ওপরই আঘাত। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এর আগে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার গোবিন্দপুরে বাউলদের একটি আখড়ায় পেট্রোল ঢেলে দুটি ঘর ভস্মীভূত করে দেয় কতিপয় দুর্বৃত্ত। তারা নারীসহ তিন বাউলকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করে এবং চুল কেটে দেয়। দুর্বৃত্তরা ঘরের যাবতীয় আসবাব, ধর্মীয় বইপত্র ও বাদ্যযন্ত্রাদি জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলে। আখড়ার মালিক ৬৫ বছর বয়সী জুলমত শাহ ছয় বছর আগে গোবিন্দপুর গ্রামে তিন বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলেন আখড়াটি।
তারও আগে জীবননগর উপজেলার একতারপুরে বাউল আখড়ায় আকস্মিক হামলা চালিয়ে তিন বাউলকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এর বাইরেও মুন্সীগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানেও আখড়াসহ বাউলদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনাও আছে, যেখানে মেলা উপলক্ষে সমবেত বাউলদের জোরপূর্বক চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনাসহ প্রতিবাদ, বিক্ষোভও হয়েছে।
গত ক’বছরে দেশে মৌলবাদী ও জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থানে তাদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। সর্বস্তরের মানুষ একে স্বাগত জানিয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশের পাড়া ও মহল্লায় সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধে কাজ চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সর্বস্তরের মানুষের গণপ্রতিরোধই পারে দেশ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে। দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতির ওপর ন্যক্কারজনক হামলা ও আঘাত যে কোনো মূল্যে চিরতরে বন্ধ করতে হবে। স্বভাবকবি রাধাপদ সরকারের ওপর হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে বলেই প্রত্যাশা।