
একসময় স্কাইপের নাম এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে মানুষ ‘স্কাইপ করা’ কথাটিকে ‘গুগল করার’ মতোই স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেসটাইম, জুম ও গুগল মিট-এর মতো সেবাগুলো স্কাইপের জায়গা দখল করে নেয়। এছাড়া স্মার্টফোন যুগের জন্য উপযুক্ত না হওয়া এবং উচ্চাকাক্সক্ষী বেশ কিছু পদক্ষেপের ভিড়ে স্কাইপের সেবার মান উন্নত না করায় প্রযুক্তি দুনিয়ায় বিপ্লব সংঘটিত করা এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান হলো চলতি মে মাসেই।
শুরুর গল্প
স্কাইপের যাত্রা শুরু হয় ২০০৩ সালে। সুইডেন-এস্তোনিয়ার কয়েকজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী এই প্রকল্পের পেছনে কাজ করেন। এক বছর পর, ২০০৪ সালে এটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে সময় ইন্টারনেটের গতি কম হলেও স্কাইপ ভয়েস কল ও পরে ভিডিও কলের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটায়। ২০০৫ সালে স্কাইপকে কিনে নেয় ইবে (eBay)। তবে ২০১১ সালে মাইক্রোসফট এটাকে ৮.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। এটি ছিল মাইক্রোসফটের জন্য একটি বড় বিনিয়োগ। সে সময় স্কাইপকে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে সংযুক্ত করা হয়।
প্রযুক্তিগত অবদান
ভিডিও কলে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রথম প্ল্যাটফর্ম ছিল এটি। অ্যান্ড টু অ্যান্ড এনক্রিপশনের মাধ্যমে অত্যন্ত সুরক্ষিতভাবে মেসেজ আদান-প্রদান, ভিডিও কল ও গ্রুপ কল করার সুবিধা পাওয়া যেত। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য এনক্রিপশনযুক্ত যোগাযোগ মাধ্যম ছিল এটিই প্রথম। হ্যাকারদের জন্য স্কাইপে পাঠানো মেসেজ পড়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল কাজে লাগিয়ে তৈরি পরিষেবা স্কাইপ। শুরুতে এটি ব্যবহার করত পিয়ার টু পিয়ার সিস্টেম। তখন কেন্দ্রীয় সার্ভারের ওপর নির্ভর না করে ব্যবহারকারীদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ তৈরি হতো, যা পুরোপুরি এনক্রিপ্টেড। অ্যান্ড টু অ্যান্ড এনক্রিপশনে শুধু মেসেজ আদান-প্রদানকারীরাই মেসেজ দেখতে পারেন। স্কাইপ কর্তৃপক্ষও এই মেসেজ দেখতে পারে না। আজ প্রায় সব মেসেঞ্জার অ্যাপই ব্যবহার করে এনক্রিপশন, যার শুরুটা করেছিল স্কাইপ। তবে পিয়ার টু পিয়ার সিস্টেম ধীরে ধীরে বন্ধ করে সার্ভারভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থা ব্যবহার করতে শুরু করে এই সেবা, যদিও এনক্রিপশন সিস্টেম অটুট ছিল।
স্কাইপই প্রথম অ্যাপ্লিকেশন- যা বিশ্বব্যাপী ফ্রি ভয়েস কল ও ভিডিও কলের সুযোগ দেয়। পিয়ার-টু-পিয়ার (P2P) প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্দান্ত অডিও-ভিডিও মান নিশ্চিত করেছিল স্কাইপ। ফাইল শেয়ারিং, স্ক্রিন শেয়ার, এবং গ্রুপ ভিডিও কলের মতো সেবাকে সহজ করে তোলে এটি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল এবং ল্যান্ডলাইন নম্বরে কল করার সুবিধা এনে দেয় স্কাইপ, যা ছিল একটি বৈপ্লবিক সেবা। এই অ্যাপটি শুধু পারিবারিক কথোপকথনেই নয়, অফিসিয়াল মিটিং, অনলাইন ক্লাস, দূরবর্তী চাকরি ইত্যাদিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
পতনের কারণ
বর্তমানে স্কাইপের গোপনীয়তা নীতি বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যবহারকারীদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি ও তথ্য চুরির অভিযোগ উঠেছে। তাই মাইক্রোসফটও স্কাইপ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। কয়েক বছর ধরেই স্কাইপের সুরক্ষা নিয়ে সন্দেহের গুঞ্জন চলছে। বিভিন্ন দেশের সরকার স্কাইপ ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি করার বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। যেমন- ইতালীয় সরকার স্কাইপের এনক্রিপশন ভাঙার উপায় বের করার জন্য প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল প্রায় দেড় দশক আগেই। ২০০৮ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল অধিকার গবেষণা দল আবিষ্কার করে, চীনা গুপ্তচররা আড়ি পাতার জন্য স্কাইপের একটি পরিবর্তিত সংস্করণ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা গোপন নথি থেকে জানা যায়, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে কল ও মেসেজ সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে স্কাইপের মালিক মাইক্রোসফট।
মিসরীয় বিপ্লবের সময় ২০১২ সালের ৫ মার্চ ভোরে কায়রোতে অবস্থিত স্টেট সিকিউরিটি ইনভেস্টিগেশনস (এসএসআই) সার্ভিসের গোপন সদর দপ্তরে তল্লাশি চালায় মিসরীয় বিপ্লবীরা। সেখান থেকে উদ্ধার করা নথিপত্রে প্রথম জানা যায় ফিনফিশার নামের এক সফটওয়্যারের কথা। এটি ব্রিটিশ-জার্মান কোম্পানি গামা ইন্টারন্যাশনালের তৈরি। ই-মেইল হ্যাক, অন্যান্য ডিভাইসে স্পাইওয়্যার আপলোড করা, ডিভাইসের সব ধরনের যোগাযোগ ট্র্যাক করা, এমনকি এর মাধ্যমে নেওয়া যায় ডিভাইসটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, এটি দিয়ে স্কাইপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা যেত। এটিই স্কাইপ হ্যাকের প্রথম অকাট্য প্রমাণ।
সবমিলিয়ে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয় স্কাইপ। জুম, গুগল মিট, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেইসটাইম, ডিসকর্ডের মতো প্রতিযোগীদের সঙ্গে তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে স্কাইপ। প্রতিটি অ্যাপ স্ক্যাইপের তুলনায় আরও উন্নত ইউজার ইন্টারফেস ও দ্রুত সেবা দিতে সক্ষম হয়। করপোরেট সেবার ক্ষেত্রে টিমসকে অগ্রাধিকার দেয় মাইক্রোসফট। যার ফলে পিছিয়ে পড়ে স্কাইপ। স্কাইপের মূল প্রযুক্তি ছিল পিয়ার-টু-পিয়ার ভিত্তিক, যা পরবর্তীতে নিরাপত্তা ও স্কেলিং সমস্যার মুখে পড়ে। সেই সঙ্গে মোবাইল অ্যাপ সংস্করণে জটিলতা ও আপডেট আসতে বিলম্বও ইউজারদের বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে।
স্কাইপ নস্টালজিয়া
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ স্কাইপের মাধ্যমে প্রথমবার ভিডিও কলে মুখোমুখি হয়েছিল প্রিয়জনের। দূরদেশে থাকা প্রবাসীদের কাছে এটি ছিল আবেগের নাম। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে এটি ছিল গ্রুপ স্টাডির একটি বড় মাধ্যম। করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে স্কাইপ আবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই জুমের জনপ্রিয়তার কাছে হার মানে এই ঐতিহ্যবাহী অ্যাপ।
ভবিষ্যতের বার্তা
মাইক্রোসফট ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে স্কাইপ ব্যবহারকারীরা তাদের তথ্য ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। এরপর অ্যাকাউন্ট এবং সংরক্ষিত তথ্য মুছে ফেলা হবে। আজকের প্রজন্ম হয়তো স্কাইপের নামও শুনবে না। কয়েক বছর পর পুরনো ইউজাররাও এর নাম ভুলতে শুরু করবেন। কিন্তু যারা ২০০০ এর দশকে ইন্টারনেটের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে, তাদের কাছে এটি শুধুই একটি অ্যাপ নয়, বরং এক টুকরো নস্টালজিয়া। বিদায় স্কাইপ, তুমি একসময় পৃথিবীকে কাছে এনেছিলে।
প্যানেল