
ছবি: সংগৃহীত।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি যুদ্ধবিমানগুলোর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং নকশার জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। এগুলো বিশ্বের সর্বাধুনিক যুদ্ধজানবাহিনীর অংশ—এবং যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব-রাজনীতির প্রধান সামরিক শক্তি। অনেক রাষ্ট্রই এই আধুনিক বিমানের মালিক হতে চায়। কারণ, এমন বিমানের মালিক মানেই আধুনিক প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অর্জনের গর্ব।
কিন্তু বাস্তবতা কি এতটাই সরল?
যখন কোনো দেশ আমেরিকার কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কেনে, তখন শুধু একটা প্লেনই কেনে না—সাথে কিনে নেয় একগুচ্ছ শর্ত, রাজনৈতিক সংযম ও নজরদারির বেড়াজাল। প্রথম ধাক্কা আসে ‘এন্ড-ইউজার এগ্রিমেন্ট’ (EUA) এর মাধ্যমে, যেখানে স্পষ্ট বলা থাকে—এই বিমান যেখানে-সেখানে, যার বিরুদ্ধেই খুশি হয়ে ব্যবহার করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে এদের ব্যবহার প্রায় অসম্ভব।
১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে পাকিস্তান তাদের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করতে পারেনি EUA-এর শর্তে। বিমানের গতি ছিল, গোলা ছিল, কিন্তু ওড়ার অনুমতি ছিল না।
১৯৭০-এর দশকে ইরান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮০টির মতো এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেট কিনেছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র সব প্রযুক্তিগত সহায়তা ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলাফল: একে একে অচল হয়ে পড়ে সেই সময়ের সেরা যুদ্ধবিমানগুলো।
ভেনেজুয়েলা ১৯৮০-এর দশকে কিনেছিল এফ-১৬। কিন্তু হুগো শ্যাভেজের আমেরিকাবিরোধী নীতির কারণে সেখানেও একই ঘটনা। বিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে, হ্যাঙ্গারে ঘুমিয়ে পড়ে যুদ্ধবিমান।
ইন্দোনেশিয়াও এই নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়। ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুরে গণহত্যার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে তাদের এফ-৫ টাইগার-টু রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আরও একটি বড় বাধা হল ITAR (International Traffic in Arms Regulations)। এর আওতায় প্রতিটি বিমানের সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এমনকি যন্ত্রাংশের উপরও যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারি থাকে। ফলে বিমান মেরামত, উন্নয়ন বা অন্য দেশে হস্তান্তর—সবকিছুতেই ওয়াশিংটনের অনুমতি আবশ্যক।
২০১০ সালে ব্রিটিশ অস্ত্র নির্মাতা BAE Systems এমন একটি লঙ্ঘনের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা খেয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল: ক্রেতা দেশ মালিক হলেও আসল নিয়ন্ত্রণ থাকে নির্মাতার হাতে। চাইলেই বিমানের আপগ্রেড বা রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না। রাজনৈতিক সম্পর্কে টান পড়লেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে স্পেয়ার পার্টস বা টেকনিক্যাল সাপোর্ট।
এই বাস্তবতা কূটনৈতিকভাবে অনেক দেশের জন্য কষ্টদায়ক—কিন্তু নতুন নয়।
পৃথিবীতে বিকল্প আছে—ফ্রান্সের রাফাল, সুইডেনের গ্রিপেন, রাশিয়ার এসইউ-৩৫, চীনের জেএফ-১৭ বা জে-১০সি। কেউ কেউ স্বাধীনতার জন্য এই বিকল্প বেছে নিচ্ছে।
তুরস্ক উদাহরণ হতে পারে, যারা নিজেরাই এখন ড্রোন ও যুদ্ধবিমান তৈরিতে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করছে।
যখন কেউ আমেরিকার কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কেনে, তখন সে শুধু একটি আকাশসীমা রক্ষাকারী যুদ্ধজান নেয় না—সে নেয় রাজনৈতিক আনুগত্যের শর্তাবলি, সফটওয়্যার নজরদারি এবং কূটনৈতিক দায়বদ্ধতা।
নুসরাত