
বর্তমানে ডেঙ্গুও মহামারির আকার নিচ্ছে
করোনা মহামারি ২০২০ সালে অসহনীয় দাপটে সারা বিশ্বকে অস্থির করে তুলেছিল। বর্তমানে ডেঙ্গুও মহামারির আকার নিচ্ছে। ছড়িয়ে পড়া এই ভয়াবহ ডেঙ্গুকে কিভাবে সামলানো যাবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। বাংলাদেশ এই অসহনীয় মুহূর্ত পার করতে কেমন যেন হিমশিম খাচ্ছে। নিয়ত রোগী আর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। ফলে, চরম দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্ট আঙিনায়। ৯ মাস অতিক্রান্ত করা ডেঙ্গু নিত্যনতুন রেকর্ড তৈরিতেও সমানভাবে এগিয়ে থাকছে। উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি হরেক জটিলতায় আবর্তিত রোগটির আসলে কোনো কূল কিনারা করতে না পারাও সময়ের দুর্দশা তো বটেই। আমরা এখনো ডেঙ্গু আক্রমণের দুঃসহ মাসটিকে ধরার অপেক্ষায়।
গত কয়েক মাসে ভয়াবহভাবে সম্প্রসারিত ও অপ্রতিরোধ্য ডেঙ্গু নিরাময়ের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে দেখা যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে চরম আশঙ্কিত অবস্থায় জনজীবন বিপর্যস্ত। সামনে হয়তো দুঃসময়ের অপেক্ষাই করছে। আতঙ্ক আর দুর্ভোগ কবে পিছু ছাড়বে তারও কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত মিলছে না।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন কর্মকা-ে হরেক নতুন প্রকল্পে জোর কদমে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অনাকাক্সিক্ষত ডেঙ্গুর চরম ছোবল প্রবৃদ্ধির আঙিনাকে নাকাল করতে যেন মরিয়া। এমনিতেই উন্নয়নের সম্মুখ যাত্রায় আপদ-বিপত্তিও মাথা চাড়া দিচ্ছে। বিজ্ঞানী নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতে, সব ক্রিয়াকর্মের একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।
দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় নানা কারণে হোঁচট খাওয়া যেন পরিস্থিতিরই বিপরীত আবহ। মহামারির আকার নেওয়া ডেঙ্গু রোগকে পিছু কিভাবে হটানো যায় তারও যথার্থ দিকনির্দেশনা অনেকটাই অনুপস্থিত। শরৎকালে দেশের প্রকৃতি ¯িœগ্ধ সতেজ পরিবেশে আবর্তিত হয়, যাকে প্রকৃতির চিরায়ত সম্ভার বললে অত্যুক্তি হয় না। ২০২৩ সালে সেই শান্ত সাবলীল ঋতুটি বারবার ডেঙ্গুকে সম্মুখসমরে মোকাবিলা করেছে। ফলে, নানা প্রতিকূলতা ও দুঃসংবাদে চিরায়ত প্রাকৃতিক সম্ভারই যেন প্রশ্নবিদ্ধ।
ষড়ঋতুর বিচিত্র দেশ আমাদের এই আবহমান বাংলা। ঋতুচক্রের বৈশিষ্ট্যে শাশ^ত বঙ্গভূমি আপন শৌর্যে মহীয়ান অনন্তকাল ধরে। তবে বর্তমানে আমরা না অনুভব করি গ্রীষ্মকালকে, না দৃশ্যমান হয় বর্ষাকাল। দুই ঋতুর অস্বাভাবিক বাতাবরণ শরৎকালকেও তার সহজাত বৈশিষ্ট্য থেকে অপসৃত করতে যেন অপেক্ষমাণ। সেভাবে হেমন্ত আর শীতের আবহ বুঝতেও সময় লেগে যাওয়া বর্তমান প্রতিবেশ পরিস্থিতির নির্মমতা। আর ফাল্গুন-চৈত্র্যের ঋতুরাজ বসন্তও কি তার সহজাত সম্ভারে আগের মতো ক্রিয়াশীল? সময়ে তার যথাযথ জবাবও আমরা পেয়ে যাচ্ছি। দেশ কয়েক মাস ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ সহ্য করে আধুনিক ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্তের সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী ইতোমধ্যে ২ লাখ রোগী পার হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। আগে কোনো সময়েই এভাবে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার দুঃসহ চিত্র সামনে আসেনি। দিন দিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি স্বাস্থ্য খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। শুধু কি আক্রান্ত? সরকারি হিসাব মতে, মৃত্যুর সংখ্যাও বর্তমানে হাজারের ওপর। সেপ্টেম্বরেই মারা গেছেন ৩৮২ জন। এডিস মশাবাহিত রোগটির ধরনেও দেখা দিচ্ছে পরিবর্তন। এডিস মশার দিনের আলোতে কামড়ানো এবং সংশ্লিষ্ট শরীরে রোগ জীবাণু প্রবেশ করার চিত্র পাল্টে গেছে। এখন রাতের বেলায়ও এডিস মশা কামড়ায় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ঘরে জন্মানো স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা তার লার্ভা ছড়ায়। বৃষ্টির পর জমে থাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ পানিতেও মশাটির লার্ভা পাওয়া যায়। দেশের মহাপ্রকল্পগুলোর পরিত্যক্ত ও ছড়ানো-ছিটানো জিনিসগুলোয় বৃষ্টির পানি জমে, যা এডিস মশার প্রজনন স্থান হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত। এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশ এডিস মশার প্রজননে যথেষ্ট অনুকূল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৃষ্টি মানেই নগর, বন্দর শহরে জলাবদ্ধতা। তখন স্যাঁতসেঁতে প্রতিকূল পরিবেশও দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান হয়, যা এডিস মশার প্রজননে বিশেষ উপযোগী। এসব বিষয় আমলে নিতে ব্যর্থ হলে সামনের দিনগুলোতে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্ষা, পরবর্তীতে শরৎ ঋতুতে বৃষ্টি যেন কোনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করছে না। এই সময় হরেক বহুতল ভবন তৈরির যে মহাসমারোহ, সেখানে আবর্জনার স্তূপে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। সহসাই এই পানি নিষ্কাশন সম্ভব হয় না। সঙ্গত কারণে জলাবদ্ধতা রাজধানীসহ সারাদেশে এক বড় ধরনের সীমাহীন দুরবস্থা। বৃহত্তম নগরী ঢাকায় নিয়ত এমন সমস্যা জিইয়ে রাখায় পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক অবস্থায় যাচ্ছে।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুরন্ত কর্মযোগের অভিগামিতায় নিত্যনতুন গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশ পাচ্ছে। সেসবে বিশদভাবে উঠে আসছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শুধু নিরাময়ের ওষুধ নয়, চিরস্থায়ী টিকা উদ্ভাবনও জরুরি। যা করোনা মহামারির জন্য অত্যাবশ্যক ছিল, সেটা এবার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে উপস্থিত বিপন্নতাকে সামলানোর জন্য। তেমন টিকা উদ্ভাবনে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত গবেষণা কিছুটা আশার আলো ছড়াচ্ছে। ডেঙ্গু নিরসনকল্পে বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি এবং আমেরিকার ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের যৌথ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে তা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানা যায়।
ধারণা করা হচ্ছে এক ডোজেই ডেঙ্গুর চার রকমের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। তবে প্রতিষেধক মানে সুস্থ ব্যক্তিদেরও দেওয়া যাবে। বয়সের কোনো হেরফের না থাকাটাও স্বস্তিদায়ক বিষয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ- সব বয়সের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ভাবার অবকাশ নেই বাংলাদেশও বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রায় বিশ্বে নিজেকে প্রমাণ করতে মোটেও পিছিয়ে নেই। অতি অবশ্যই এই সংকটকালে প্রয়োজন ছিল নতুন প্রতিষেধক উদ্ভাবনের। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের যথার্থ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রস্তুতি নেওয়া মানেই সফলতার দ্বারে অনেকখানি এগিয়ে থাকা।
সর্বশেষ আরও একটা ট্রায়াল জরুরি যা সফলভাবে করতে পারলেই বিশ্ব দেখবে এক নতুন চমক যা সুস্থ এবং আক্রান্ত রোগীকে এই ভয়াবহ রোগ বালাই থেকে মুক্তি দিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। তবে সব ধাপ অতিক্রম করার পরও লাগবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন। সেটা জরুরি শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট ডেঙ্গুর জন্য কতখানি প্রযোজ্য তাও যাচাই করা হবেÑ যা প্রচলিত নিয়মধারার অনুবর্তী। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের জন্য নতুন আবিষ্কৃৃত টিকার নিরাপত্তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তাও একান্ত আবশ্যক। সব নিয়মকানুন মেনেই নতুন আবিষ্কৃত প্রতিষেধকটি জনবান্ধব করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সকলের ধারণা। যেটা করা হয়েছিল মহামারি করোনা প্রতিষেধকের জন্য। এবারও তার কোনো ব্যত্যয় হবে না বলে সকলে আশাবাদী।
করোনা মহামারি আক্রান্তের প্রাক্কালেই ২০২০ সালেই ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপে সারাদেশ অস্থির ও নিতান্ত দুর্ভোগের শিকার হয়। সে সময়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হলেও পরবর্তীতে তা নিম্নগামী হতে সময় লাগেনি। তবে ২০২১, ২০২২ সালে ডেঙ্গুর সামান্য প্রকোপ এলেও তা নিয়ন্ত্রণে ছিল। তার ওপর করোনার মহাদুর্ভোগ এবং পরবর্তীতে প্রতিষেধক আবিষ্কার সব মিলিয়ে ডেঙ্গু যেন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালে আবারও ডেঙ্গু নতুন মাত্রায় সবাইকে অস্থির করে তোলে। রোগটির ভয়াবহ আক্রমণে এবার জরুরি হয়ে যায় চিরস্থায়ী নির্মূলের প্রতিষেধক টিকা। ডেঙ্গু মূলত মশাবাহিত রোগ।
বিশ্বে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দেশসমূহে রোগটির সম্প্রসারণের আশঙ্কা রয়েছে। তার ওপর উন্নয়নশীল দেশের নানামাত্রিক কর্মযোগে খানাখন্দ, বড় আকারের গর্তের নাকাল অবস্থায় এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। সঙ্গতকারণে উন্নয়নকে অবধারিতভাবে এগিয়ে নিলেও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রতিবেশও সুরক্ষিত রাখতে সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে দায়িত্বভার নেওয়া পরিস্থিতির ন্যায্যতা। পানি জনগণকে ব্যবহার করতে হয়, যার শুদ্ধতা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনাকাক্সিক্ষত জলাবদ্ধতা ছাড়াও হরেক বর্জ্য দূষণের শিকারও হতে হচ্ছে এই স্বচ্ছ পানিকে। চলছে ডেঙ্গুর মারাত্মক ছোবলের অসহনীয় দুঃসহ ক্রান্তিকাল। তাই সম্প্রসারিত রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সব ধরনের ব্যবস্থাগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক