ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক ও দুস্থ শিল্পী

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ৭ জুন ২০২৩

ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক ও দুস্থ শিল্পী

বাজেট বা রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাবের মতো জটিল বিষয়

শুরুতেই বলি, বাজেট বা রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাবের মতো জটিল বিষয় নিয়ে আমার কিছু বলা একেবারেই সাজে না। তবু দু’চারটি বিষয় অনেকদিন যাবৎ ভাবায়। সেগুলো প্রকাশ পাওয়া এবং ব্যক্তিগত মত-পরামর্শ দেওয়ার তাগিদ বোধ করছি। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে- সরকার বা রাজস্ব বিভাগকে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী শহরে কত সংখ্যক বাড়ি বা ফ্ল্যাট মালিক আছেন, সেটি কি জরিপ চালিয়ে জানা যায় না? তাদের সবাইকে কি ট্যাক্স বা রাজস্বের আওতায় আনাটা আইনিভাবেই সম্ভব হতো না কি?
সদ্য শেষ করতে পারা ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে আমার বসতি যে অ্যাপার্টমেন্টে, সেটির একটি পুরনো ফ্ল্যাটের সদ্য ক্রেতা মহিলার লাগানো তালা ভেঙে দখল করার অদৃষ্টপূর্ব ঘটনার সমাধানের কথা বলতেই হবে। এমন একটি ঘটনায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তা ছাড়াও, আকস্মিকভাবে এতদিনের পুরনো ভবনের সমিতিতে যারা ছিলেন, তাদের অনেকে মারা যাওয়ার পর একটি তরুণ গোষ্ঠী নিজেরাই সমিতি গঠন করে চালিয়ে আসছিল। দেখা গেল তাদের দ্বারা দুর্নীতি বৃদ্ধির কারণে তাদেরই একজন আমাকে নির্বাচন করে প্রেসিডেন্ট হয়ে নতুন কিমিটি গঠন করার জন্য জোরাজুরি করতে শুরু করে। ফলে, একসময় নির্বাচিত হয়ে আমি এর দায়িত্ব নিতে রাজি হই। উল্লেখ্য, ’৯৬ সালে বসবাস শুরু করলেও কোনো ফ্ল্যাট কেনাবেচা হচ্ছে এসব সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ ছিলাম।

ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রথমেই ঠিক করলাম দীর্ঘদিনের গ্যাস সংকট নিরসন করা দরকার। এ কাজের উদ্যোগ নিলাম এবং সফলও হলাম। পরপর যৌথ পানি ও বিদ্যুতের বিল সংক্রান্ত কাজও প্রায় শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন ভোরে দারোয়ান জানাল সিসিটিভি বন্ধ এবং নতুন মহিলা মালিক সদ্য কেনা এক প্রাক্তন সচিবের ফ্ল্যাট কিনে ভেতরের কাজ শুরু করেছে। সে ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ভোরে ভেতরে ঢুকে বসে আছে। আমার আয়ুষ্কালে কখনো এ ধরনের বড় অপরাধ করতে কাউকে দেখিনি। আমার জন্য ছিল ফ্ল্যাট উদ্ধারের এক লড়াই। ফ্ল্যাট উদ্ধার হলো স্থানীয় প্রশাসন, থানা, স্থানীয় মানুষের সাহায্যে। নতুন মালিক মহিলাকে চাবি বুঝিয়ে দিলাম।

অনেক দিন পর একদিন গলি পথে বেরিয়ে রিক্সা ধরতে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় এক বাইক থামল, এক তরুণের চাইতে কিছুটা বয়সী ব্যক্তি বাইকে বসা অবস্থায় বলল- ‘আপনি তো অমুক ভবনের সমিতির সভাপতি, একটা ফ্ল্যাট দখলমুক্ত করেছেন, খুব ভালো। কিন্তু জানেন কি ওই ভাড়াটিয়া, যার ফ্ল্যাটে বাস করে সেটিও দখলীকৃত কিছু টাকা দিয়ে মাস্লম্যান বা গু-া দিয়ে দখল করা। এ কারণেই এই ভাড়াটিয়ার এত সাহস হয়েছিল। তাই চোখের ওপরে দেখা দৃষ্টান্ত তাকে অপরাধ করতে, একটি খালি ফ্ল্যাট দখল করতে মদত দেয়। লোকটি বাইক চালিয়ে চলে গেল। মাথায় ঢুকিয়ে দিল এক প্রশ্নÑ ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি ফ্ল্যাট দখল হলে নিশ্চয় আরও এমন দখলের জন্য লোভী ব্যক্তি এবং একই সঙ্গে ভুয়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানি থাকবে এবং থাকাটা অসম্ভব নয়। সর্বশেষ, আমরা কিন্তু ওই দখলদারকে এ ভবন থেকে বের করতে পারিনি। 
উক্ত দীর্ঘ বর্ণনার প্রয়োজন রয়েছেÑ রাজস্ব বা করের পরিধি বৃদ্ধি করার একটি বড় উপায় হতে পারে এ খাত। প্রথমত, ঢাকা শহরের ওয়ার্ডভিত্তিক ফ্ল্যাট মালিকদের নির্মাতা-বিক্রেতা, ফ্ল্যাট কেনা, ক্রয়মূল্য, হোল্ডিং ট্যাক্স, কেনার মূল দলিল, নামজারি আছে বা নেইÑ এসব তথ্য বের করতে হবে। আমরা নিশ্চিত, পুরো ঢাকার প্রায় চল্লিশ লাখ ফ্ল্যাট বাড়ির মধ্যে ২৫% হতে পারে জবর দখলকারী ও অন্যান্য অপরাধী- যাতে ফ্ল্যাট মালিকের নাম, পরিচয় বের হয়ে আসবে। বের হবে হোল্ডিং ট্যাক্স দেয় না এমন ভুয়া ফ্ল্যাট মালিক হয়ে বসা লোকদের নাম, পরিচয়। এ জরিপটি সম্ভবত ভূমি অফিস শুরু করেছে, কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত সঠিক সার্বিক কাজটি হয়নি বলেই মনে হয়। কর অঞ্চলের নোটিস পেতে আমার ফ্ল্যাট ক্রয়ের দলিল দিয়েছি গত বছরের শেষে। অন্য অনেকে এই কাজটি করেনি।

এমন সবার দলিল পেলে অন্য সব অপরাধমূলক তথ্যও বেরিয়ে আসবে। এখানে জরিপের ফলে ট্যাক্স ধার্য করে বড় একটি কর ফাঁকি দেওয়ার মতো ব্যক্তিদের পরিচয় পেয়ে তাদের তৎক্ষণাৎ করের আওতায় আনতে হবে। এভাবে ফ্ল্যাট-জমি দখলদারদের ভুয়া দলিলও বের হয়ে আসবে। মনে করি, সরকার ভূমি অথবা রাজউক কর্মকর্তাদের দ্বারা এই কাজটি জরিপ শহরজুড়ে করতে পারে। এটা সত্য যে- রাজস্ব আদায়কারী বা জরিপকারী সবসময় আন্তরিক হয় না। আর ঘুষ ছাড়া রাজস্ব দিতে ইচ্ছুকদের কাছ থেকে রাজস্ব প্রায় নেয়ও না।
ফ্ল্যাট মালিক চিহ্নিত করার জরিপ কাজটি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট জেলায় আপাতত বছরব্যাপী করা হলে সম্ভবত সব শহর মিলে কোটি কোটি নতুন রাজস্ব দাতার নাম, পরিচয় বেরিয়ে আসবে। দখলদারদের দলিল অবশ্যই নকল। সেটি মুক্ত করতে হবে রাজউক বা ভূমি মন্ত্রণালয়কে। কোনো একটি ডিজিটাল প্রযুক্তি বের করতে হবে, যেটি ভুয়া মালিকদের শনাক্ত করে নকল মালিকদের উচ্ছেদ করে আসল মালিককে ওই সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। পুরো ঢাকা শহরে বহু রিয়াল এস্টেট বহু জমির মালিককে, অনেক ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের ছবি দেখিয়ে হাজার হাজার আগ্রহী ক্রেতাদের কাছ থেকে বুকিং মানিসহ পরবর্তী কয়েক ইনস্টলমেন্ট তুলে নিয়ে বিল্ডিংয়ের অর্ধেকও প্রস্তুত না করে চলে গেছে, যাদের কাছ থেকে পরে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক কিছুই পাননি।

এসব রিয়াল এস্টেট মালিকদের বিচার করে জেল দিলেও কাজ হবে না। মালিককে অর্থদ-াদেশ দিয়ে ওই অর্থ জমির মালিককে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়াও রিয়াল এস্টেট মালিকের তা বিক্রি করে অর্থ ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমরা স্বামী-স্ত্রী সারা জীবন দু’জনে কষ্ট করে নানা কাজ করে অর্থ উপার্জন করে বর্তমান ফ্ল্যাটটি কিনেছিলাম সেই ’৯৩-’৯৬ সালে। তখন কম মূল্য পরিশোধ করতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম। সে সব যখন আমি ফ্ল্যাট দখল মুক্ত করে উপস্থিত জনতা, বিশেষত দখলকারী স্ত্রীকে জানাচ্ছিলাম, তখন স্ত্রীটি গালে হাত দিয়ে নির্বাক হয়ে গেল। এরপর সে আর টুঁ শব্দটি করেনি। অথচ এর আগে অনর্গল উদ্ভট দাবি জানাচ্ছিল। সেই নারী নীরব হয়ে তার ঘরে ফিরে গিয়েছিল।

তবে যেদিন ওই নাম না জানা অপরিচিত আগন্তুক ওদের থাকার ফ্ল্যাটটিও পেশিশক্তি দ্বারা দখল করা হয়েছিল বলে জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, সেদিন থেকে আগে কোনদিন যা জানা ছিল না যে সেই নতুন অপরাধ- দখল করা জমি বা ফ্ল্যাট পাকা দলিল করে না কিনে অল্প টাকা দিয়ে বা না দিয়ে, বা শুধু ‘বায়না’র টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট ভোগদখল করেÑ এ অজানা অপরাধমূলক সত্যটি হঠাৎ উদ্ঘাটিত হলো।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মতো অর্থনীতিতে অনভিজ্ঞ একজন মানুষ বাজেট প্রণেতাদের জানা ঘটনাই হয়তো আবার বলছি। এ খাতটিকে খুব খুঁটিয়ে জরিপ ও মনিটরিং করার প্রয়োজন আছে। এটি করার জন্য প্রয়োজনে সুপারিশ হবে- এই কাজটি রাজস্ব বিভাগের কর অঞ্চলের কর্মকর্তাদের পক্ষে নির্ভুলভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে অর্থ লেনদেন বাদ দিয়ে হওয়া সম্ভব হবে বলেই মনে হয়। দখলবাজদের পক্ষে কাজ করার সম্ভাবনা থাকায় এটি রাজউকের অধীন বা ভূমি-রাজস্ব বিভাগের অধীন কোনো আলাদা কমিশন গঠন করে করা হলে এ খাতের দুর্নীতি, দখলদারী বন্ধ করা যাবে। জরিপকারীদের জন্য প্রত্যেক জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটের মূল দলিলের কপি নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। তা হলে থলের ‘কালো বিড়াল’ বেরিয়ে আসবে নিশ্চয়ই।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই বাজেটে সংসদ সদস্যদের জন্য বিনা শুল্কে গাড়ি আনার সুযোগ না রাখার জন্য বলব। ভবিষ্যতে কোনো সংসদ সদস্য শুল্ক দিয়েই গাড়ি বিদেশ থেকে আনতে চাইলে আনবেন। সংসদ সদস্যরা, প্রশাসকরা যে জনগণের সেবক, প্রভু নয়, তারাও আমাদের মতো নাগরিকের সমান, সে সত্যটি খর্ব হওয়ার মতো কোনো নীতি, নিয়ম যেন না থাকে- সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জনগণ দরিদ্রের সেবা চায়, বেকারের চাকরি চায়, নিরক্ষরের সন্তানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগের সমতা চায়, দরিদ্র-মধ্যবিত্তের সুচিকিৎসা চায়, কৃষকের কষ্টের ফসলের কাছে আমরা মাতৃগর্ভের মতো জন্ম থেকেই ঋণী।

এসব পেশার মানুষের কাছে আমাদের এত ঋণÑ তাদের সঙ্গে তাদের পাশে আলাদা করে কোনো জনপ্রতিনিধিকে সুবিধা দেওয়া দৃষ্টিকটু এবং নৈতিক বলে মনে হয় না। জানি, ওদের তৃণমূলে ভোটার, এলাকার উন্নয়নের কাজ দেখতে যেতে হয়। এই কাজের গাড়িগুলো সরকারি পুলে থাকবে এবং যে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী যখন গাড়ি তৃণমূল পরিদর্শনে ব্যবহার করবেন, তখন তেলের ব্যয়টা নিজেরা মেটাবেন। মন্ত্রীর পরিবারের প্রয়োজন থাকলে নিজের কেনা প্রাইভেট কার ব্যবহার করবেন।
তৃতীয়ত, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজ, কর্মসূচী দেশব্যাপী তৃণমূলের সঙ্গীত ও যন্ত্রশিল্পীদের কল্যাণে কাজ করা। বাউল-জারি, সারি, ভাটিয়ালি, নানা পল্লীগীতি, রবীন্দ্র-নজরুল-পঞ্চকবির গান ও উচ্চ নৃত্য, লোকনৃত্য, গৌরীয় নৃত্য- নানা রকম গান ও নাচে জড়িত অনেক তরুণ- তরুণী, শিশু-কিশোররা। তাদের পাশে আছে বিশাল যন্ত্রসংগীত শিল্পীÑ যারা ঢাক-ঢোল, কাঁসি, মন্দিরা, হারমোনিয়াম, একতারা, দোতারা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, তবলাসহ বাংলার নানা রকম যন্ত্র বাজিয়ে গানের, নাচের সঙ্গত করেন। ছবি আঁকা, মাটির প্রাণী, দেবী, পশু, পাখি, হাঁড়ি-পাতিল তৈরিতে জড়িয়ে আছেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। তাদের মধ্যে যারা অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছেন, তাদের বাদ দিয়ে দরিদ্র বাউল-পল্লীগীতির গায়কদের মাসিক একটি ভাতা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাই। 

লেখক : শিক্ষাবিদ

×