ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মার্কিন ভিসানীতি এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

ড. মো. আবদুর রহিম

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২৯ মে ২০২৩

মার্কিন ভিসানীতি এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনী জে. ব্লিঙ্কেন নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনী জে. ব্লিঙ্কেন ২৪ মে ২০২৩ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন উৎসাহিত করার জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। কোনো দেশের নির্বাচন উৎসাহিত করার জন্য আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের ভিসানীতি আগে কখনো ঘোষণা করেছে বলে জানা নেই। এ কথা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান রাখতে সহযোগী রাষ্ট্রগুলোকে তাগাদা দিয়ে থাকে। ঘোষিত নীতি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর কি প্রভাব ফেলতে পারে তা বিশ্লেষণ করাই এ নিবন্ধের লক্ষ্য। নতুন মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের সচেতন মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। 
আগে দেখা যাক ঘোষিত ভীসানীতিতে কি আছে। ভিসানীতির সেকশন ২১২(এ)(সি) (৩) (‘৩সি’)-এর ইমিগ্রেশন এ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট-এর আওতায় অবাধ, স্বচ্ছ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করাই ঘোষিত নীতির উদ্দেশ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ নীতির আলোকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। বর্তমান ও সাবেক আমলা, সরকারি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচারবিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জন্য এ নীতি প্রযোজ্য হবে।

গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, ভোটারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, সহিংসতা সৃষ্টি, মানুষকে ভোটাধিকার প্রদানে বাধাসৃষ্টি, দল ও শান্তিপূর্ণ  সমাবেশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ অথবা গণমাধ্যমকে মতামত প্রচারে বাধা প্রদান এসবের আওতায় পড়বে। এখানে আরও বলা হয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে, ভোটার, রাজনৈতিক দলসমূহ, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম সকলের দায়িত্ব রয়েছে। ব্লিঙ্কেন বলেছেন ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে চান যারা তাদের সকলের উদ্দেশে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি’।
ভিসানীতি ঘোষণা করার পর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার বাসায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে ভিসানীতি ঘোষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন। অবশ্য ড. মোমেনের সঙ্গে বৈঠকটি পূর্ব নির্ধারিত ছিল বলে রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তিনটি দলই মার্কিন ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে- এবং সবদলই মনে করে ভীসানীতি তাদের পক্ষে গেছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির আপত্তি নেই, ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই ভিসানীতি ঘোষণা করেছে’।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ নীতিকে স্বাগত জানিয়ে ক্ষমতাসীনদের ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে বড় ধরনের সিগন্যাল বলে উল্লেখ করেছেন । এদিকে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন,‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বলেছেন, নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা নয়, আমাদেরও একই কথা, নির্বাচনে যারা বাধা দেবে তাদের প্রতিহত করব (জনকণ্ঠ-২৬ মে ২০২৩)। মানে দাঁড়াল, আওয়ামী লীগ আর যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিষয়ে এক সরল রেখায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন,‘মার্কিন ভিসানীতি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহযোগিতা করবে বলে আশা করি। যারা জ্বালাও পোড়াও করে তারা হয়ত এ থেকে বিরত থাকবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীসহ এদেশের অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন চাওয়া ব্যক্তিদের সহযোগিতা করতে এ নতুন ভিসানীতি গ্রহণ করেছি আমরা’। ভিসানীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর খুশি আছে বলে জানা যায়। এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত কোনো পলিসিতে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ‘খুশি’ হয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষকে সমর্থন করাই এ নীতির উদ্দেশ্য বলে তিনি জানান। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার  জন্য নিরন্তরভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও সারা জীবনের সংগ্রামই ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পক্ষে।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামরিক ছাউনি থেকে আসা দু’দুটি অগণতান্ত্রিক সরকারকে মোকাবিলা করে দেশ স্বাধীন করেছেন। সে সময় মার্কিননীতি পাকিস্তান সামরিক শাসকদের পক্ষে গেছে। তাঁর কন্যাও একইভাবে দুজন সামরিক জেনারেল ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের হাতে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলকে মোকাবিলা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তখনও সত্যিকার অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবেকহীনভাবে নির্লিপ্ত থেকেছে। আমরা পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাব, পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছিল। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া সামরিক উর্দি খোলার জন্য নির্বাচনের নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। প্রথমে ১৯৭৭ সালে ‘আইয়ুবীয়’ পদ্ধতির গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল। হ্যাঁ-না ভোটে তিনি একাই প্রার্থী ( লোকেরা নাকি বলত- হ্যাঁ ভোট পড়লে ধরে নেওয়া হবে জিয়ার পক্ষে আছি, না ভোট পড়লে ধরে নেওয়া হবে জিয়াকে ছাড়া অন্য কাউকে চাই না।

এরপর ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কী হয়েছিল জাতি এখনও তা ভোলেনি। জিয়ার শাসনামলে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে খোদ সামরিক বাহিনীতেই ২১টি অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। সর্বশেষ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁর দুঃখজনক মৃত্যু ঘটে। পরবর্তী সামরিক জেনারেল এরশাদ ‘শান্তিপূর্ণ’ ক্যু’র মাধ্যমে ১৯৮২ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের বর্জনের মুখে ১৯৮৫ সালে গণভোটের আয়োজন করে। ভোটারবিহীন (প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা চাকরি বাঁচানোর জন্য ছাত্রদের দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরিয়েছিলেন) নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলে ৭২.৪ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি এবং প্রদত্ত ভোটের ৯৪.১৪ ভাগ এরশাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শাসন পরিচালনার পক্ষে দেখানো হয়। শেষ পর্যন্ত এরশাদকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পদত্যাগ করতে হয়। 
বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার সূচনা হয় ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। এ সময় গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপসহ দমন-নির্যাতন চালায় ১৯৫৮ সালের জেনারেল আইয়ুব খানের মডেল অনুসরণ করে। প্রহসনের নির্বাচনেও সহিংসতা, মারপিট ও হতাহতের খবর সামরিক নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমেও অল্পবিস্তর উঠে এসেছিল। এখনকার মতো স্বাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মুক্ত গণমাধ্যম থাকলে চিত্রটি আরও ভয়াবহ হতে পারত।

 বিরোধী দলের লোকজনকে ভোট প্রদানে বাধা প্রদান, ভীতি প্রদর্শন, রাজনৈতিক জনসভায় ব্রাশফায়ার করে হত্যাকা- চালানো, বাড়ি ঘরে হামলা, ভাংচুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট অগ্নিসংযোগ, প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ওপর হামলা, গণধর্ষণ, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের বাধাদান, বোমা হামলা, এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার- এসব ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিছু গণমাধ্যমে এসব খবর বের হয়েছিল। এসব তথ্য নিশ্চয় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিতেও থাকার কথা। কোথায় ছিল ভোটাধিকার, কোথায় গণমাধ্যমের কথা বলার অধিকার, সুশীল সমাজই বা কোথায় ছিল?

যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব অবৈধ কর্মকা-ের বৈধতা না দিত, তবে বাংলাদেশ দুনিয়ার অন্যতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারত। কারণ, বাংলাদেশের ত্রিশলক্ষ মানুষ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার এক কোটিরও বেশি জাল ভোটার বাতিল করে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন বলেই দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ থেকে কমে ১৮.৭ শতাংশে এবং একই সময়ে চরম দারিদ্র্য ২৫.১ থেকে ৫.৬ শতাংশে নেমেছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে। এসব কিছু নিশ্চয় যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় আছে। 
দীর্ঘবিরতির পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়নি। ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। স্মরণযোগ্য যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার সূচনা হয় ১৯৭৫ সালে। আবার ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর প্রেক্ষাপটে ওয়ান ইলেভেনের জন্ম হয়। হোঁচট খায় শেখ হাসিনার দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল গণতন্ত্র। জেলে গেলেন দুই নেত্রী। সে সময়েও যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো বক্তব্য শোনা যায়নি। বরং অরাজনৈতিক একজনকে রাজনীতিতে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুপ্রবেশ ঘটানোর প্রচেষ্টা তারা করেছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের  নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে।

পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত একটি সরকার উচ্ছেদ করে বিএনপি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল ঘোষিত তথাকথিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার যে কোনো ব্যক্তি বা দলের থাকতেই পারে। সেটিই তো গণতান্ত্রিক রীতি। কিন্তু অন্যের ভোটাধিকার প্রদান ও ভোটে অংশ নেওয়ার অধিকারে বাধা প্রদান করার অধিকার তো গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় নেই।

ভোট প্রতিহত করার নামে লাগাতার হরতাল, ধর্মঘট, ভাংচুর, লুটপাট, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে শতশত নিরীহ মানুষ হত্যা, থানায় হামলা, অস্ত্রলুট, পুলিশ হত্যা, গবাদি পশু হত্যা, গাছ কাটা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে যারা জাহান্নামে পরিণত করেছিল, তাদের অনেককে ভিসা দিয়ে আত্মগোপন করার সুযোগ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেও সরে দাঁড়ায়। তারা যদি পূর্ণমাত্রায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে নির্বাচনে থেকে হেরেও যেত, তবু নির্বাচনের ত্রুটিবিচ্যুতির কথা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেত। 
যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দেখতে চায় এবং এর পেছনে কোনো ভিন্ন উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে এই ভিসানীতি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে যাবে। একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য শেখ হাসিনার যে প্রত্যয়, তার পক্ষে এ নীতি হবে সহায়ক। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে। একই সঙ্গে এ নীতি বিএনপির বর্তমান রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে। কেননা, বিএনপি ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। শুধু তাই নয়, যে কোনো মূল্যে তারা নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ওয়ার্ম-আপ কর্মসূচিও শুরু করে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ভয় পেয়ে আবারও শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিধ্বংসী কর্মসূচি দিয়েও গত দুই বারের নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ দাঁড় করতে পারেনি।

এবার যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতির ফলে সহিংসতা করে সে দেশে পাড়ি জমানোর পথও বন্ধ হলো। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত কারার কথা বলেনি, বলেছে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে। সে দেশেও অনেক রাজনৈতিক দল আছে, সকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না।  স্বাভাবিক ভাবেই গণতন্ত্রে কোনো রাজনৈতিক দলই কিন্তু অপরিহার্য নয়। কালের আবর্তে পৃথিবী থেকে বহু রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাতে জনগণের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়নি।

গণতন্ত্রের মূল কথা হলো জনগণের অংশগ্রহণ। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের আগে জাসদ রবের নেতৃত্ব রাতারাতি জন্ম নেওয়া ৭৬টি রাজনৈতিক দল ‘কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি’ নামে একটি কোয়ালিশন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও এরশাদকে বৈধতা দিতে পারেনি। আবার বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো ক্ষতি হয়নি । মূল কথা হলো জনগণের অংশগ্রহণ। 
যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিকে বাংলাদেশে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এ নীতির ভূতপূর্ব কার্যকারিতা দিয়ে অতীতে যারা জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসন জারি করেছিল, জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল, নির্বাচন বর্জনের নামে লাগাতার হরতাল-ধর্মঘট কর্মসূচি দিয়ে (এখনও সেই হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহৃত হয়নি) মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার হরণ করেছিল, তাদের ওপর এবং অগণতান্ত্রিক পন্থায় জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলের বিষয়ে তাদের যদি নীতি সুস্পষ্ট করে, তবেই তাদেরকে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রের বন্ধু হিসেবে বাহবা দেবে।

ইতোমধ্যে বিএনপি নেতাদের নির্বাচনবিরোধী বক্তব্য সংযুক্ত করে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ কী হয়, সেটার ওপর তাদের নীতির সারবত্তা বোঝা যাবে। একই সঙ্গে আগামীতে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে, তাদের বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতি কতটা কার্যকর হয়, তা দেখার অপেক্ষায় রইল বাংলাদেশের জনগণ। 


লেখক : অধ্যাপক, প্রাধ্যক্ষ, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

×