ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

এই দেশ এই স্বাধীনতা

ড. মো. আবু তাহের 

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১৬ মার্চ ২০২৩

এই দেশ এই স্বাধীনতা

ড. মো. আবু তাহের

প্রফেসর জোসেফ ক্যাম্পবেলের মতে, ‘তিনিই নায়ক যিনি তার নিজ সত্তার থেকে বড় কিছু রেখে যান।’ জাতির ইতিহাস ও ধারাবাহিক সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু এমন একজন মহানায়ক, যিনি আজীবন বাঙালি জাতিকে শুধু মুক্তির স্বপ্নই দেখাননি; মানুষকে সম্পৃক্ত করে সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন। বাঙালির ইতিহাসে তেমন কেউ আর আসেনি।

এ প্রসঙ্গে লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Observer পত্রিকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক ঈুৎরষ উঁহহ লিখেছেন- ‘In the thousands year history of Bengali, Sheikh Mujib is her only leader who has, in terms of blood, race, language, culture and birth, been a full blooded Bengali. His physical stature was immense. His voice was redolent of thunder. His charisma worked magic on people. The courage and charm that flowed from him made him a unique superman in these times.’
সত্য যে, প্রত্যেক জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। অপেক্ষায় থাকতে হয় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা পুরনো পথ ভেঙে জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করার সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য। সেদিন কে জানত টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ মুজিব একদিন বড় হয়ে স্বাধীন বাংলার সাহসী-তেজস্বী-বিস্ময়কর-দূরদর্শী নেতা তথা মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধুরূপে আত্মপ্রকাশ করবে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে উপসংহারে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন ‘পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এ দরিদ্র-লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে। মানুষকে চরম আশ্বাসের বাণী শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’ কবিগুরুর এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল, যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান ঘটে। বিশ্ব রাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনব্যাপী সাধনার ফল।

বস্তুত ব্রিটিশ শাসকরা উপমহাদেশকে শাসন করার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে বিভিন্নরূপে ব্যবহার করা সত্ত্বেও উনিশ শতকের শেষার্ধে কংগ্রেস এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মুসলিম লীগ প্রথমে মুসলমানদের ধারক-বাহক হয়ে উঠলেও পরে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রদূত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে পেলাম হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এ রাজনীতির পরিণতিতেই হয়েছে বাংলা ভাগ।

মূলত দুই বঙ্গকে এক করার জন্য নয়; বরং পূর্ববঙ্গের বাঙালিকে পরিপূর্ণরূপে বাঙালি করার জন্য প্রয়োজন ছিল মুক্তিযুদ্ধের। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি হওয়ার যে আকাক্সক্ষা নিয়ে ’৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। এ যেন মাতৃগর্ভে শিশুর বেড়ে ওঠাÑ জন্মলাভের উদ্দেশ্যে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় কেবল উপমহাদেশের ইতিহাস ও ভৌগোলিক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেননি; বরং তিনি নিজেই এতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। দেখেছেন, জন্মের পর থেকে দেশ ভাগ পর্যন্ত ব্রিটিশদের শোষণ;  নেতৃত্ব দিয়েছেন ২৩ বছরের পাকিস্তানিদের শোষণ-শাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি তাঁরই নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র নেতা যিনি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটিয়ে অন্ধকারের অপশক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করে সকলের ঐক্যবদ্ধতায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্য এই দেশ, এই জাতি আজীবন বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী।

শোষণ-দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। ফলে যেসব তরুণ পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছিলেন সেসব বাঙালি তরুণের  একাংশের ১৯৪৮ সালের মধ্যেই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ফিরে এলেন ঢাকায়। প্রতিষ্ঠা করেন ‘ছাত্রলীগ’ ও ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এদিকে বাঙালিদের মনে মুসলিম লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঘনীভূত হতে থাকে। বাঙালির আন্দোলন ও সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তাঁকে বহুবার কারাবরণ ও অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি কখনো শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আপোস করেননি।

অবশেষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ১১০৮টি শব্দের সমন্বয়ে ১৮ মিনিটের এক জাদুকরী ভাষণের মাধ্যমে পুরো বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর করে তোলেন। তাঁর এ উদ্দীপ্ত ভাষণকে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা, অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা বলা যেতে পারে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণের শেষে দুটি শব্দ ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ ব্যবহার করেছিলেন, যা অত্যন্ত তাৎপর্যম-িত। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি পিরিয়ডিক্যাল, যা রাজনৈতিক, ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহৃত হয় আর ‘মুক্তি’ শব্দটি নন-পিরিয়ডিক্যাল, যা অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয়। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম চলমান থাকে। একটি জাতি স্বাধীন হলেই মুক্তি সুনিশ্চিত হয় না; বরং মুক্তির জন্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। বঙ্গবন্ধু সেই মুক্তিই চেয়েছিলেন, যা স্বাধীনতাকে করে তোলে অর্থবহ।

তাই বলেছিলেন ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে যদি এদেশের মানুষের মুক্তি না আসে।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয়সম বিশাল উচ্চতার একজন ব্যক্তি, যিনি বাঙালির মন ও মননে চির জাগরূক হয়ে থাকবেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন মানুষের হৃদয়ে অম্লান থাকবে বঙ্গবন্ধুর  সংগ্রামী গৌরবগাথা। 
পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের লেখাটির সমাপ্তি টানছি-
এই দেশকে যে নিজের মনে ভাববে, এই দেশ তার। এ দেশের কল্যাণ দেখে যার মন খুশিতে ভরে উঠবে এই দেশ তার, এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার, এই দেশ তাদের যারা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। 

লেখক : অধ্যাপক
সদস্য, বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

×