ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২২ মার্চ ২০২৩, ৮ চৈত্র ১৪২৯

monarchmart
monarchmart

সিডনির মেলব্যাগ

প্রবাসে বাংলা বাঙালি ও জীবনযোদ্ধা

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রবাসে বাংলা বাঙালি ও জীবনযোদ্ধা

সিডনিতেও একটি জমজমাট বইমেলা হয়। একুশের বইমেলা

সিডনিতেও একটি জমজমাট বইমেলা হয়। একুশের বইমেলা। যখন সিডনি আসি তখন সাকল্যে কয়েক হাজার বাঙালির বাস। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নানা জায়গায়। তখন একটি বইমেলার আয়োজন ছিল দুঃসাধ্য। কিন্তু যেখানে বাঙালি সেখানেই একখ- বাংলাদেশ। আমাদের পরিচিত বন্ধুজন নেহাল নেয়ামুল বারী। বরিশালের বাঙালি। এই ভদ্রলোক সে সময় স্বপ্ন দেখলেন একটি বইমেলা করার। কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাজিত হয় যে কোনো সীমাবদ্ধতা। তাই হলো। সবুজ মাঠে চাদর বিছিয়ে শুরু হলো বইমেলা। কিছু বই-পুস্তক মাটির বুকে শুয়ে সেদিন যে শক্তি জুগিয়েছিল তাই আজ হয়ত বড় বইমেলার শিকড়।
আজ পার্কে একুশে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছে মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধ আমাদের অহংকার। প্রশান্তপারের বাঙালির পরিচয় সূত্র। দেশের গণ্যমান্য মানুষজন থেকে সাধারণ সিডনিবাসী সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এটি। এখানে সমবেত হয়ে একুশের অনুষ্ঠান বা মেলা যেমন হয়, তেমনি হয় আমাদের প্রতিবাদ। সবাই জানি বাংলাদেশে এখনো স্বাধীনতা বিরোধীদের দাপট বা হুংকার যায়নি। এরা দেশের পাশাপাশি বিদেশেও সক্রিয়। বলতে গেলে বেশিই সক্রিয়।

তাই আমাদের সমবেত হওয়ার একটা শক্তি দরকার। সিডনির মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ সে কাজে আমাদের সহায়ক। এর পাদদেশে বইমেলায় এবার দেশ থেকে আসছে স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা। যাদের পুস্তক ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের নির্ণায়ক তাদের নিয়ে আসায় বইমেলার সুনাম ও গুরুত্ব বাড়ে। এই শুভ সূচনা তার প্রমাণ দেয়।
সিডনির সাংস্কৃতিক জগতের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যও কমবেশি সক্রিয় ও বিচরণশীল। আমি এখন এমন সব তরুণ-তরুণীকে দেখি যাদের ভেতর বাংলা বাঙালির চিরন্তণ ধারা কাজ করে। বিশেষত যারা দেশ থেকে পড়তে আসে তাদের মনে মগজে বাংলা জাগরূক। সঙ্গে থাকা সম্প্রতিকালের লেখা ছবি ভাবনা বা ধারা। তারা যত আসবে, যত থেকে যাবে, তত আমাদের হারাই হারাই ভাব কাটবে।

মনে করি বাংলা ও বাঙালি পৃথিবীর কোনো দেশে পরাভব মানেনি। বরং যেসব দেশে যত বেশি সময়ের বসবাস, সেসব সমাজে তত আমাদের জায়গা বা ভিত্তি মজবুত। এই সেদিন শুরু হলেও সিডনিও পিছিয়ে নেই।
এখন দরকার পৃষ্ঠপোষকতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, অনুবাদ সাহিত্যের ওপর জোর দিতে হবে। এটা আসলেই দামি কথা। তিনি আমাদের বাংলা ভাষায় অনুবাদের ওপর যেমন জোর দিয়েছেন, তেমনি জোর দিয়েছেন আমাদের ভাষা অর্থাৎ বাংলায় লেখা বই-পত্র যেন অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়। বিদেশের বাঙালিরা সেসব দেশের ভাষায় পটু হয়। হতে না পারলে তাদের জীবন চলে না। জীবিকা চলে না।

মাতৃভাষা বাংলা যেমন জানেন, তেমনি জানেন ইংরেজি, ফ্রান্স জার্মান বা স্প্যানিশ আরবিও। এ ভাষাগুলোয় তাদের পটুতাকে কাজে লাগিয়ে যদি বাংলা বইয়ের অনুবাদ করানো যায়, নিঃসন্দেহে বিদেশী পাঠকের মন পাবে আমাদের লেখকরা। জুটবে আন্তর্জাতিক তকমা। এখানে একটা কথা বলা দরকার। বিদেশের দূতাবাসগুলোও এ বিষয়ে ভালো ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শেখ হাসিনা সে কথাও বলতে ভুলেননি। তারা অর্থনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কূটনীতি করলে দেশের লাভ, জাতির লাভ।

এদেশে ক্যানবেরার দূতাবাস সে কাজে অগ্রসর হবে আশা করি। ঝামেলা একটাই, যে কোনো কাজ মানেই বাঙালির দলাদলি আর রাজনীতি। সে জায়গাটা ঠিক রাখতে পারলে আমাদের স্বনামধন্য ও নবীন সব লেখকদের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচরণ ফলবতী হতে বাধ্য।
 এসব কাজ অচিরেই শুরু হোকÑ এই প্রত্যাশা সকলের। মানুষের জীবনে তার জন্মভূমি ও সংস্কৃতি যে কত প্রবল তা ভাষার মাস এলেই টের পাই। সবাই জানেন, কানাডার বাঙালিরাই আমাদের মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন। এখন দেশের চাইতে বিদেশেই মায়ের ভাষার কদর বেশি। দেশের চাইতে বিদেশে প্রবাসীদের ভেতর বাংলা চর্চা বেশি। প্রথমত দেশ ছেড়ে আসার বেদনা, পরে যোগ হয় সন্তানদের চিন্তা। নতুন প্রজন্ম যেন বাংলা ভাষা ভুলে না যায় বা পড়তে লিখতে পারে, সে জন্য মা বাবাদের আকুলতা দেখার মতো। দেশে যেমন অভিভাবকরা টাকা পয়সা খরচ করে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, বিদেশে ঠিক তার উল্টো। সপ্তাহান্তে বহু আশা ও বিনোদনের ছুটির দিনেও তারা বাচ্চাদের বাংলা পড়াতে বাংলা শেখাতে নিয়ে ছোটে। অনেক দূরে দূরে গিয়ে বাঙালিদের গড়ে তোলা বাংলা স্কুলগুলোতে বাচ্চারা পাঠ নেয়।

এমন কোনো বিদেশে বসবাসরত বাঙালি পরিবারের দেখা মিলবে না, যাদের সন্তান বাংলা বোঝে না বা বাংলা বলতে জানে না। এই প্রাথমিক পাঠ দানের পেছনে যে আবেগই কাজ করুক না কেন, আখেরে এতে আমাদের মাতৃভাষাই প্রাণ পায়। শক্তি খুঁজে পায় নবীন প্রজন্ম।
আরও একটা বিষয়ে লিখে এই লেখার ইতি টানব। প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভবত দেশের চেয়েও বেশি ক্রিয়াশীল। এটা এখন শীর্ষ নেতারাও জানেন। এই প্রক্রিয়ার বাইরে নেই সিডনিও। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত সবাই আছে। বাহ্যিকভাবে সরকারি দলের কর্মকা- বেশি এবং তাদের কাজকর্ম চোখে পড়লেও এটা সবাই জানেন। তবে কেউ কম যায় না।

জামায়াত-বিএনপি আছে অন্দরমহলে। তাদের সাপোর্ট বা সমর্থন বেশি। যেহেতু এটা দেশের বাইরের এক আধুনিক গণতান্ত্রিক নগরী, এখানে মুক্তবুদ্ধি আর মুখ খোলায় বিপদ নেই। তেমনি আবদ্ধচিন্তাও ভয়হীনভাবে চলে। ফলে, প্রগতিশীল ধারা বজায় রাখা সহজ নয়। যারা অন্য সরকারগুলোর আমলে এখানে ছিলেন, তারা জানেন কতটা কঠিন ছিল দেশের পাশে দাঁড়ানো। তেমনই একজন বলিষ্ঠ মানুষ গামা আবদুল কাদির। ভদ্রলোককে আমি যত দেখি বিস্ময় মানতে বাধ্য হই।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির কত ধরনের পরিবর্তন ঘটে। কত কত বদলানো দেখলাম। তিনি সেই তখন থেকে এখনো এক ও অনন্য। তিনি বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালিত্ব থেকে এক পাও নড়েননি। আছেন মানুষের মনে। সর্বস্তরের বাঙালি বাংলাদেশীর হৃদয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি এখনো সক্রিয়। বিদেশের মাটিতে দেশজ প্রগতির এক বটগাছ। এভাবেই একুশে বাংলা বাঙালি নিয়ে আমাদের বসবাস। আমাদের অস্তিত্ব এখানে, শিকড় বাংলাদেশে। আমরাই গর্বিত বাংলাদেশী প্রবাসীযোদ্ধা

[email protected]

monarchmart
monarchmart