ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল সংযুক্তির মেলা

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২২:১৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ডিজিটাল সংযুক্তির মেলা

.

বাংলাদেশে কম্পিউটার প্রযুক্তি আসে ১৯৬৪ সালে। এর নায়ক নাটোরের মুহম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়া। ১৯২৯ সালের নভেম্বর তার জন্ম। এক সময় আমার ধারণা ছিল সেটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কম্পিউটার। কিন্তু গুগলের কোনো কোনো লিঙ্ক বলছে অন্য কথা। গুগলের দেওয়া একটি তথ্য অনুসারে প্রথম এনালগ কম্পিউটার তৈরি হয় ১৯৫৩ সালে ভারতেই। আর ভারতে ডিজিটাল কম্পিউটার আসে ১৯৫৫ সালে। তবে বাংলাদেশে কম্পিউটারের জনপ্রিয়তার সঙ্গে বাংলা ভাষার নিবিড় সম্পর্ক আছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে কম্পিউটার দিয়ে প্রথম টাইপরাইটারের কাজ শুরু হয় ১৯৮৫ সালে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে। ১৯৮৭ সালের ১৬ মে সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় মুদ্রণ প্রকাশনায় কম্পিউটারের ব্যবহার। সাধারণ মানুষের কাছে কম্পিউটার জনপ্রিয় হবার কারণও সেই প্রকাশনাটি। ৯৩ সালের মাঝে দেশের প্রায় সকল সংবাদপত্র বই কম্পিউটারে প্রকাশিত হতে থাকে। কম্পিউটারের ব্যবসায়ীরাও ব্যবসার সম্প্রসারণে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেই সময় মাগমিট নামক একটি সংগঠন ১৯৮৯ সালে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভলিবল খেলার মাঠে মাত্র ৪টি মেকিন্টোস কম্পিউটারের একটি মেলার আয়োজন করে। আমার জানা মতে বাংলাদেশে এর আগে কম্পিউটারের কোনো মেলা হয়নি। ববটরিন নামক একজন বিদেশীও এই মেলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি মুনিম হোসেন রানাসহ আমরা কয়েকজন এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

কম্পিউটারের দ্বিতীয় মেলাটির আয়োজন হয় ১৯৯২ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেলে। আয়োজক ছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার ক্লাব। আমি এর সভাপতি ছিলাম। তৃতীয় মেলাটির আয়োজন হয় ১৯৯৩ সালে হোটেল সোনারগাঁও-এ। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি আয়োজিত বিসিএস কম্পিউটার শো নামের সেই মেলাটিই আজ পর্যন্ত আয়োজিত কম্পিউটার বিষয়ক দীর্ঘস্থাায়ী মেলা। করোনা ছাড়া প্রায় প্রতি বছরই বিসিএস এই মেলার আয়োজন করে। কেবল তা- নয়, বিসিএসই ঢাকার বাইরে জেলা বা বিভাগীয় শহরগুলোতেও মেলার আয়োজন করেছে। ১৯৯৮ সালে আগারগাঁও-এর আইডিবিতে আয়োজন করা হয় বিশাল কম্পিউটার মেলা। ২০০৩ সালে বিসিএস বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রথম মেলার আয়োজন করে। একই বছর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেসিস সফটএক্সপোর আয়োজন করে। সরকারের মধ্যে কম্পিউটার বিষয়ক বা ডিজিটাল মেলার আয়োজন করে আসছে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। ডাক টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রথম মেলার কথা ভাবে ২০১৯ সালে। ২০ সালে মেলাটির আয়োজন করা হয়। ১৮ সালে বার্সিলোনায় ৫জিসহ অন্যান্য টেলিকম প্রযুক্তি দেখার পর আমরা ভাবি এর সঙ্গে জনগণের পরিচিতি দরকার। সেজন্যই ১৮ সালের জুলাইতে ৫জি টেস্ট করা হয় ২০ সালে মেলার আয়োজন করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২১-২২ সালে সেই ধারাবাহিকতা করোনার জন্য রক্ষা করা যায়নি।

ডিজিটাল সংযুক্তি মেলাÑ তিনদিনব্যাপী ডিজিটাল সংযুক্তিরডিজিটাল বাংলাদেশ মেলা-২০২৩’-এর সফল সমাপ্তি হলো গত ২৮ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গত ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ এক ভিডিও বার্তায় ডাক টেলিযোগাযোগ বিভাগ আয়োজিত এই মেলার উদ্বোধন ঘোষণার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলা শুরু হয়। তরুণদের ডিজিটাল উদ্ভাবন প্রদর্শন এবং তাদের উদ্ভাবনী প্রতিভাকে কাজে লাগানোর জন্য এবারের ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলা ছিল একটি উপযুক্ত প্লাটফর্ম। তিনদিনের এই মেলায় এক লাখ ৮৫ হাজার দর্শকের পদচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো।

আমি মনে করি ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলার মাধ্যমে অনাবিষ্কৃত মেধার বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক প্রতিভাবান তরুণ রোবট বানিয়ে প্রমাণ দেখিয়েছে বাঙালির সুপ্ত প্রতিভার। ডাক টেলিযোগাযোগ বিভাগ ২০২০ সালের ১৬ থেকে ১৮ জানুয়ারি প্রথম ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলার আয়োজন করে। ২০২১ সালে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ যুগ অতিক্রম করেছি। ২০২১ ২২ সালে করোনার জন্য মেলার আয়োজন করা যায়নি। ২০২২ সালে পরিকল্পনা করে ২০২৩ সালে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলার শেষ পর্বটি উপস্থাপন করলাম। আমি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করছি আগামী দিনের এই মেলা হবে স্মার্ট বাংলাদেশ মেলা। বছরের এই মেলার মধ্য দিয়ে আমরা ডিজিটাল যুগের অর্জনগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানবসম্পদ সৃষ্টি, ডিজিটাল প্রযুক্তির আধুনিক সংস্করণের সঙ্গে জনগণের সেতুবন্ধন তৈরি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলে ধরাই ছিলডিজিটাল বাংলাদেশ মেলা-২০২৩’-এর অন্যতম মূল লক্ষ্য।

ডিজিটাল বাংলাদেশের সংযুক্তির মহাসড়কএই প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত এবারের মেলার ৭৭টি ছোট-বড় প্যাভিলিয়ন এবং ৫২টি স্টলে আইসিটি কোম্পানি, টেলিকম অপারেটর, মোবাইল আর্থিক পরিষেবাদাতা, ইন্টারনেট এবং অবকাঠামো কোম্পানি অংশ নেয়। পাশাপাশি দেশের তরুণ উদ্ভাবকদের নিয়ে ছিল উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতা প্রদর্শনী। আগামী ডিজিটাল প্রযুক্তি কী হবে তা এখনো কল্পনাও করা যায় না। আগামী দিনের প্রযুক্তি আমাদের ছেলে-মেয়েরাই তৈরি করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের দেশের তৈরি আইওটি ডিভাইস সৌদি আরবে রপ্তানি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের শক্তিশালী ভিত্তির ওপর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবেই।

ডিজিটাল সংযুক্তিই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার সেরা হাতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলা-২০২৩’-এর উদ্বোধন উপলক্ষে ভিডিও বার্তায় বলেছেন, (ভিডিও বার্তার চুম্বকাংশ এখানে তুলে ধরা হলো) ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন রাঙ্গামাটি জেলার বেতবুনিয়ায় প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেন। এই ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির গোড়াপত্তন হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে আমরা বেসরকারি খাতে মোবাইল ফোন উন্মুক্ত করে দেই। যার ফলে সাধারণ মানুষের হাতে দ্রুত মোবাইল ফোন পৌঁছে যায়। কম্পিউটারের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করি। কম্পিউটারের ট্যাক্স কমিয়ে দেই।

সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগের উদ্যোগ নেই। সকল ফোন এনালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তর করি। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করি যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের আর্থ-সামজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ২০১৮ সালে আমরা মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- উৎক্ষেপণ করি। এর মাধ্যমে ব্রডকাস্টিং থেকে শুরু করে টেলিযোগাযোগের সব খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আর বিদেশী স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভর করতে হয় না। অন্যদিকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অব্যবহৃত তরঙ্গ ভাড়া দিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা।সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। স্মার্ট জাতি গঠন করা। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্ট ইন্টারনেট অব থিংস, ভার্চুয়েল রিয়েলিটি, অগমেন্ট রিয়েলিটি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে চাই। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে ৫৭তম স্যাটেলাইট পরিবারের গর্বিত সদস্য। গত বছর সিলেট, সুনামগঞ্জ নেত্রকোনায় ভয়াবহ বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বহুমুখী কার্যক্ষমতাসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- উৎক্ষেপণের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এখন সিমিউই৪ সিমিউই৫- যুক্ত আছে। এছাড়াও আছে আইটিসি কানেকশন। বেসরকারি খাতে নতুন ৩টি সাবমেরিন ক্যাবল লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

সিমিউই -এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ৩৪০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি অর্জন করছে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি আরও ৩৮০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ বৃদ্ধি পেয়ে মোট ৭২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটিতে উন্নীত হবে।

সরকার সিমিউই৬- যোগ দেওয়ার ফলে১৩২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ বিদ্যমান কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হবে। সাবমেরিন ক্যাবল থেকে প্রাপ্ত ব্যান্ডউইথ সৌদি আরব, ফান্স, মালয়েশিয়া ভারতে লিজ প্রদান করে বাংলাদেশ ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। ৩য় সাবমেরিন ক্যাবল ২৫ সালের মধ্যে স্থাাপিত হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন. ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের অংশ হিসেবে সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় লাখ ৫৬ হাজার শত ৯৮ কি.মি. অপটিক্যাল ফাইবার স্থাাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নের ১০ গিগাবাইট ধারণক্ষমতার সংস্থান রাখা হয়েছে। যার ফলে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হবে। এই অবকাঠামোকে ভিত্তি করে জেলা উপজেলা পর্যায়ে মোট হাজার ৬০০ ডাকঘরে ডিজিটাল ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে।

 

ঢাকা ফেব্রুয়ারি ২০২৩

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী

[email protected]
www.bijoyekushe.net

×