ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

তারুণ্যের অনুপ্রেরণা একুশের চেতনা

রফিউল কলিম রিফাত

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

তারুণ্যের অনুপ্রেরণা একুশের চেতনা

.

প্রতিটি জাতি চায় নিজস্ব ভাষার স্বাধীনতা, প্রাণ খুলে কথা বলার অধিকার আর স্বাধীন ভূমিতে বসবাস করার নিশ্চয়তা। এই অধিকার অর্জনের ইতিহাস শুধু বাঙালিদেরই আছে। জন্মের প্রথম লগ্ন থেকেই বাংলা ভাষা এতটাই উন্নত এবং সমৃদ্ধ যে, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অগণিত মানুষকে এক সূত্রে বাঁধতে পেরেছিল। হাজার বছরের সমৃদ্ধ ভাষাকে কালগর্ভে ছুড়ে ফেলতে চেয়েছিল স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু মাতৃদুগ্ধসম এমনই এক ভাষাকে যখন বর্জন করার আদেশ এলো, তখন সন্তানদের বুকে খুব স্বাভাবিকভাবেই বেজে উঠেছিল বিদ্রোহের দামামা, যা আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে। একুশ শুধু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। একুশ বৃহত্তর অর্থে সংস্কৃতিক আন্দোলন, আর্থ-সামাজিক আন্দোলন আর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল।
১৯৫টি দেশের ৭০০ কোটিরও বেশি মানুষ ছয় হাজার ৯০৯টি ভাষায় কথা বলে। তাদের এত ভাষার মধ্যে শুধু বাংলা ভাষার সম্মানার্থে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে নিঃসন্দেহে ইংরেজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। তবে শিক্ষা, ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রে যেভাবে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে যেন মাতৃভাষার শুদ্ধচর্চা বজায় থাকে, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা জরুরি। আমাদের দেশে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন মাধ্যমে ও কারিকুলামে বিভক্ত হয়েছে। যা ভাষা এবং জাতিগত দিক দিয়ে দিন দিন আমাদের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি করছে। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পরও ভুল বানানের ছড়াছড়ি সর্বত্র। যুগের পর যুগ নানাভাবে এ বিষয়ে কথা উঠলেও বাংলার অবমাননা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। রাজধানীর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই নামকরণ করা হয়েছে বিদেশী ভাষায়। কোথাও আবার বিদেশী শব্দ লেখা হয়েছে বাংলায়। আবার কোথাও অহেতুক বাংলা শব্দকে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাংলা ভাষা রক্ষায় সচেষ্ট হবে। নিজের ভাষার সম্মান নিজেদেরই রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। অপরিচিত ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ফলে নিজস্ব চিন্তা ও মেধাশক্তিকে যথার্থভাবে বিকশিত করতে পারেনি বলে বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান ভয়ানক সমস্যায় জাতি আজ জর্জরিত। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা ও গবেষণার ফলে।

তাই বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক অবহেলার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়গুলো বাংলাতেই করা এখন সময়ের দাবি। যে কোনো সাইনবোর্ড, ব্যানার বাংলায় শুদ্ধভাবে করতে হবে। সন্তানদের ছোটকাল থেকেই বাংলা ভাষা চর্চায় উৎসাহী করে তুলতে হবে। তারা যাতে সবসময় বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দেয়, সেভাবে তাদের মধ্যে ভাষার চেতনা জাগ্রত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ভাষার জন্য যে সকল যোদ্ধা শহীদ হয়েছে, সেই ইতিহাস তাদের সঠিকভাবে জানানো। নদীর মোহনা যেমন বদলাবে, তেমন হয়ত আজকের ভাষাও এক সময় নতুন বাঁক নেবে।
ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালি জাতির কাছে শ্রদ্ধা ও আবেগের মাস। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার তারুণ্যের প্রেরণা। ভাষার মাসে তরুণ প্রজন্ম আজ সেই প্রেরণাই যেন পাচ্ছে। সেই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের কাছে আত্মত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত হওয়ারও অনন্য দৃষ্টান্ত। নিজ মাতৃভাষার সঠিক চর্চা ও জ্ঞান শৈশব থেকেই মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং নিজ সংস্কৃতির পারিপার্শ্বিকতা ও ইতিহাস জানার মাধ্যমে ব্যক্তিগত পরিচয় তৈরি করে। প্রাণের ভাষা বাংলায় আজ তারা প্রকাশ করছে নিজেদের অনুভূতি। একুশের এই চেতনা বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাক নতুন প্রজন্ম। একুশ শেখায় কারও কাছে মাথা নত না করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও আত্মমর্যাদায় বলীয়ান থাকা। প্রাণের ভাষাকে ছাত্রসমাজ আজও ভালোবাসে, অনুভব করে মন থেকে। তাই আজও ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের এত অহঙ্কার, এত গর্ব। একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের অহঙ্কার। একুশের চেতনা জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বের অপরাপর ভাষাভাষীর নিজ ভাষার প্রতি অহঙ্কার এনে দিয়েছে। অনন্য উচ্চতায় বাংলা ভাষার উত্তরণ ঘটিয়েছে। একুশের চেতনা নব নব রূপে নব নব আলোকে উদ্ভাসিত হোক- অপরাজিত, চিরভাস্মর এ বাংলায়। একুশের চেতনা হতে পারে আজকের হতাশাগ্রস্ত তরুণদের অনুপ্রেরণার উৎস। তরুণরাই এই চেতনা ধরে রাখতে পারে তাদের জীবনপথে। পাড়ি দিতে পারে অতল সমুদ্র। সদা জাগ্রত তরুণ সমাজ বাংলা ভাষার মর্যাদা অটুট রাখবে।
একুশের চেতনাকে ধারণ করে পৃথিবীর বিপন্ন ও লুপ্ত মাতৃভাষাগুলোও সজীব হতে চলেছে। ব্যাপ্ত হচ্ছে ভাষাবাহিত মানববৈচিত্র্য। তারই পাশাপাশি আবহমান কালের সৃষ্টিশীল বাঙালি একুশ শতকে একুশের বিবর্তমান চেতনায় অঙ্গীকৃত হয়ে মুক্তমানবিক ও পরিপূর্ণ সুনীতিশীল হয়ে উঠুক। একুশ হোক বিশ্বব্যাপী আমাদের চিরনবায়নপ্রবণ পথ চলার শক্তি। একুশ অম্লান হোক।

লেখক : সংস্কৃতি কর্মী

×