ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

সাহাবী জুলাইবিবের (রা.) মহিমাময় জীবন

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সাহাবী জুলাইবিবের (রা.) মহিমাময় জীবন

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইসলাম, সে তো পরশমানিক। তারে কে পেয়েছে খুঁজি; পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি। রাসূল (স.)-এর সবচেয়ে অখ্যাত সাহাবীদের একজন ছিলেন জুলাইবিব (রা.)। মুসলিমদের অনেকেই তার কথা হয়তো কখনো শোনেনইনি। তাকে ডাকা হতো ‘জুলাইবিব’ নামে। জুলাইবিব আসলে কোনো নাম নয়। আরবিতে এই শব্দের অর্থ ‘ক্ষুদ্র পূর্ণতাপ্রাপ্ত’। এই নাম দিয়ে মূলত জুলাইবিবের বামনতাকে বোঝানো হতো, কেননা তিনি ছিলেন উচ্চতায় অনেক ছোট।
এছাড়া তাকে অনেকে ‘দামিম’ বলেও ডাকতেন। যার অর্থ কুশ্রী, বিকৃত অথবা দেখতে বিরক্তিকর। যে সমাজে তিনি বাস করতেন সেখানে তার প্রকৃত নাম, বংশ পরিচয় কেউ জানত না। তিনি যে কোন গোত্রের ছিলেন তাও সবার অজানা ছিল। তৎকালীন সমাজে এটা ছিল এক চরম অসম্মানের বিষয়। তিনি কোনো বিপদে কারও সাহায্য পাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। কেননা সেই সমাজে কাউকে গুরুত্ব দেওয়া হতো তার বংশ পরিচয়ের ভিত্তিতে।
মহানবী (স.) এর নবুয়্যতের শুরুর দিকে তিনি ছিলেন একজন আনসার। তার একমাত্র পরিচয় ছিল তিনি একজন আরব। খুব সম্ভবত তিনি ছিলেন মদিনা সীমান্ত এলাকার কোনো ক্ষুদ্র গোত্রের সদস্য, যিনি কিনা আনসারদের শহরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। অথবা তিনি আনসারদেরই একজন। সেই সমাজে অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করত। এমনকি আসলাম গোত্রের আবু বারযাহ নামে এক ব্যক্তি তার বাড়িতে জুলাইবিবের প্রবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছিলেন। কোনো মেয়ে জুলাইবিবকে বিয়ে করার কথা চিন্তাও করত না। সেই সমাজের মানুষের কাছে তিনি সামান্য সাহায্য, সহানুভূতিও পেতেন না।
কিন্তু মহানবী (স.) এর দৃষ্টিতে জুলাইবিবের অবস্থান ছিল অনেক ওপরে। তিনি তার এই অনুগত সাহাবীর  প্রয়োজন, আবেগ, ভালোলাগা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি জুলাইবিবের কথা চিন্তা করে একদিন এক আনসারের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার মেয়েকে চাই, বিয়ের জন্য।’ আনসার লোকটি খুবই খুশি হলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (স.), এতো খুবই দারুণ ব্যাপার।’ রাসূল (স.) বললেন, ‘আমি ওকে নিজের জন্য চাই না’।

ওই লোকটি কিছুটা হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (স.), তাহলে কার জন্য?’ ‘জুলাইবিবের জন্য’, রাসূল (স.) উত্তর দিলেন। এ কথা শুনে আনসার মনে একটা ধাক্কা খেলেন এবং নিচু গলায় বললেন, ‘আমি এ ব্যাপারে মেয়ের মায়ের সঙ্গে আলোচনা করব’। এই বলে লোকটি তার স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন এবং সব খুলে বললেন। তার স্ত্রীও তার মতোই জুলাইবিবের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব শুনে স্তব্ধ হয়ে বললেন, ‘জুলাইবিবের সঙ্গে! না, কখনোই জুলাইবিবের সঙ্গে না! নাহ, আল্লাহর শপথ, আমরা আমাদের মেয়েকে তার (জুলাইবিবের) সঙ্গে বিয়ে দেব না’।

একজন পিতা-মাতা হিসেবে একটি কন্যার ব্যাপারে এমন সংলাপ বা মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। এটা মা-বাবার দায়িত্ব ও হক। তবে আজ খোদ মহানবীর (স.) প্রস্তাব নিয়ে কথা। ইমান ও বিশ^াসের চরমতম ফয়সালার সময়। 
আনসার তার স্ত্রীর অমতের কথা রাসূলকে (স.) জানাতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। কিন্তু তার মেয়ে যিনি কি-না আড়াল থেকে সব শুনছিলেন, এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমাদের আমাকে বিয়ে দিতে বলেছেন?’ উত্তরে তার মা তাকে বললেন, রাসূল (স.) তাকে জুলাইবিবের সঙ্গে বিয়ে দিতে অনুরোধ করেছেন।
যখন মেয়েটি শুনলেন যে প্রস্তাবটি রাসূল (স.) এর কাছ থেকে এসেছে এবং তার মা সেটা প্রত্যাখ্যান করছেন, তিনি অবিচল হয়ে বললেন, ‘মা! তুমি কি জানো না একজন মুমিনের পক্ষে উচিত নয় যে, যখন আল্লাহ ও তার রাসূল কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন সে ব্যাপারে তাদের কোনো মতামত থাকে? তোমরা কি আল্লাহর রাসূল (স.) এর অনুরোধ অমান্য করছ? কত উন্নত জুলাইবিবের মর্যাদা যে, আল্লাহর রাসূল নিজেই তার পক্ষ থেকে তোমাদের মেয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।

তোমরা কি জানো না যে, ফেরেশতারা রাসূলের আশেকের পায়ের ধুলাকেও ঈর্ষা করে? আমাকে রাসূলুল্লাহর (স.) কাছে নিয়ে যাও। তিনি নিশ্চয়ই আমার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবেন না’। তিনি আরও বললেন, ‘আমি খুবই খুশি মনে নিজেকে নিবেদন করব তাতে, যাতে আল্লাহর রাসূল (স.) আমার জন্য ভালো মনে করেন।’
আল্লাহর রাসূল (স.) বিয়ের ব্যাপারে মেয়েটির  প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে শুনলেন এবং তার সহজ ও সুন্দর জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। বলা হয়ে থাকে, তখন আনসারদের স্ত্রীদের মধ্যে তার (ওই মেয়ে) চেয়ে বেশি উপযুক্ত স্ত্রী আর কেউ ছিল না। ছিলেন অতি আদুরে ও গুণবতী। বিয়ের পর জুলাইবিবের শাহাদাতের আগ পর্যন্ত তারা এক সঙ্গেই ছিলেন।
একদিন এক অভিযানে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে জুলাইবিবের শ্বশুর তাকে বললেন- ‘শোনো জুলাইবিব। এটাতো কোনো আবশ্যিক জেহাদ নয়। এটা কেবলই একটা অভিযান। তোমাদের তো মাত্র বিয়ে হলো, তাই তুমি বরং তোমার স্ত্রীর সঙ্গেই সময় কাটাও।’
জুলাইবিব, যিনি কিনা সারাজীবন দুঃখ-গঞ্জনা সয়ে এসে অবশেষে একজন ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছেন, তিনি সেই সুখময় নবজীবনের কথা না ভেবেই দ্বিধাহীন চিত্তে শ্বশুর মশাইকে জবাব দিলেনÑ ‘আব্বাজান! একি আশ্চর্যের কথা বললেন আপনি! আল্লাহর রাসূল (স.) যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবিলা করবেন আর আমি স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটাব? তিনি এতো কষ্ট করবেন আর আমি নিজের জানমাল কোরবানি না করে আরামে ঘরে বসে থাকব?’ এই বলে জুলাইবিব রাসূলুল্লাহর (স.) সঙ্গে সমর অভিযানে বের হয়ে যান। সেই অভিযানে তুমুল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় শত্রুপক্ষের সঙ্গে।

সহিহ মুসলিমের একটি হাদিস থেকে জানা যায় যে, যুদ্ধশেষে রাসূল (স.) সাহাবীদের আদেশ দিলেন তাদের পরিবার-পরিজনদের মধ্যে কাকে কাকে পাওয়া যাচ্ছে না খোঁজ নিয়ে দেখতে। সকলেই যার যার হতাহত আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে বের করে নবীজীর কাছে আসল। তখন নবীজী অশ্রুশিক্ত  নয়নে বললেন, ‘কিন্তু আমি যে আমার প্রাণপ্রিয় জুলাইবিবকে পাচ্ছি না। যাও! তাকে খুঁজে বের কর।’ তারা জুলাইবিবের ছিন্নবিচ্ছিন্ন ছোটখাটো দেহটাকে সাতজন শত্রুসৈন্যের লাশের পাশে খুঁজে পেল যাদের সে কতল করেছে।
রাসূল (স.) কবর খুঁড়তে বললেন। জুলাইবিবের দেহটাকে নবীজী নিজের পবিত্র হাতে তুলে নিলেন। তারপর বললেনÑ ‘হে আল্লাহ, পরওয়ারদিগার! আমি তার হতে, সে আমা হতে।’ তিনি এই একই কথা তিনবার বললেন। অনতিদূরে সাহাবীরা দাঁড়িয়ে অঝোর নয়নে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন- ‘আমাদের পিতা-মাতা তোমার জন্য কোরবান হোক হে জুলাইবিব, কত উচ্চ তোমার মর্যাদা!’ ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্যের কিছু সূত্র আরও জানিয়েছে যে তার জানাজায় অংশ নিতে আসা হাজার হাজার স্বর্গদূতদের আগমনে সেদিন আকাশ রওনক হয়ে উঠেছিল।

এভাবেই, সমাজচ্যুত-ভাগ্যাহত এক কদাকার বামন শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসার কারণে চূড়ান্ত স্তরের সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত হলেন। আল্লাহ- আমাদের ক্ষমা করুন, শামিল করুন আপনার অনুগত ও প্রিয় বান্দাদের কাতারে। 
লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×