ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের সংস্কৃতি

সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

শীতের সংস্কৃতি

শীতকালের মধ্যেই লুকায়িত বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি

শীতকালের মধ্যেই লুকায়িত বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি। মাঘ মাসে সারাদেশে তথা গ্রাম-বাংলার সবুজ ধানপাতা ছড়ায় তার রঙের অপূর্ব সমারোহে। আর সেই সবুজের হিল্লোলে দিশেহারা হয়ে কবিরা বার্তা প্রেরণ করে তার কবিতার মাধ্যমে। তেমনি কুয়াশার আস্তরণ মাড়িয়ে শীতার্ত মাঠ কিষাণ ছুটে যায় রাত পোহানোর আগে। গোটা শীতকাল ধরে মাঠের পর মাঠে দেখা যায় রবিশস্যের সমারোহ।

ধানপাতার গন্ধ ম-ম করে প্রান্তরের বাতাস, হরেক রকমের শাক-সবজি রঙে-রঙে ভরে ওঠে গ্রাম-বাংলা ও শহরের আনাচে-কানাচে। মূলত হিমশীতল প্রকৃতির গর্ভে অংকুরিত হয় বসন্তের ভ্রƒণ। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি মূলত শীতের এই আমেজের সঙ্গে মিশে আছে। বিশেষ করে এ দেশের গ্রামাঞ্চলে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনের সঙ্গে মিশে আছে নবান্ন উৎসব। শীতের সকালে পিঠ পেতে রোদ পোহানোর দৃশ্য ভুলে না যাওয়ার মতো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঋতু বৈচিত্র্য বিভিন্ন রকমের এবং ঋতুর স্থায়িত্বকালও একেক দেশে একেক রকম।

শীতপ্রধান দেশের ঋতু বৈচিত্র্য যেমন একরূপ, তেমনি গ্রীষ্ম প্রধান দেশের ঋতুর পালাবদল ও স্থায়িত্ব অন্যরকম। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে ঋতু বৈচিত্র্যের রয়েছে এক নৈসর্গিক গর্বিত ঐতিহ্য। আর নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের একটি দেশ হিসাবে আমাদের দেশের ঋতু বৈচিত্র্য ভিন্ন মাত্রা ও বৈভবে সম্পূর্ণ আলাদা। আবহমানকাল থেকেই আমাদের দেশে দুই মাস অন্তর ঋতুর পালাবদল হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ঋতুচক্রের বৃত্তে আবর্তমান আমাদের সময়ের পরিক্রমায় একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে আমাদের বাংলাদেশ। 
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুতেও বিশেষ বিশেষ পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন ঘটে মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণে। গ্রীষ্মের তাপদাহে এবং বর্ষার অবিরাম বৃষ্টিপাতে আমাদের জীবন যেমন ওষ্ঠাগত করে তোলে, তেমনি হেমন্তের ঝিরঝির মৃদুমন্দ বাতাস আমাদের মনেপ্রাণে এনে দেয় এক প্রশান্তির প্রচ্ছায়া। আর শীতের আবেশে ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরে তোলে আমাদের জীবনধারাকে। এই রূপময় বৈচিত্র্যের দ্যোতনা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’ বলে বাংলাদেশের প্রশস্তি গেয়েছেন- ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ’ ‘খুঁজিতে যাই না আর’ ।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে রচনা করেছেন তার অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম। তার গানের সুরে সুরে বেজে উঠেছে বাংলা ও বাঙালির প্রাণের সুর। তার কালজয়ী ভালোবাসার আবেগমথিত গান- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবসি’  ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস’ যা আজ আমাদের জাতীয় সংগীত। এই শীত ঋতুতেই বাংলাদেশে নবান্নের উৎসব শেষে চলে নানাবিদ উৎসবাদির আয়োজন।

কার্তিকের মরা মঙ্গাকে অতিক্রম করে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে ধানে ধানে। শুরু হয় রবিশস্যের নতুন আবাদ। এর ফাঁকে ফাঁকেই চলে সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক নানা উৎসবের আয়োজন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও টিভি চ্যানেল সংস্কৃতির যুগে আগের মতো না হলেও আমাদের বিনোদনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে যাত্রা ও পালাগানের আবেদন একেবারেই ফুরিয়ে যায়নি। তা আমরা টের পাই শীত এলেই। শীত এলেই যাত্রা ও পালাগানের শিল্পীরা বেরিয়ে পড়ে গ্রামের পথে প্রান্তরে, এমন কি অনেক শহর বন্দরেও যাত্রা উৎসবের শুরু হয়।
বাংলা ভাষা সাহিত্যে কাব্যে গানে কবিতায় নাটকে চলচ্চিত্রে শীতের পিঠা এবং মেয়ে জামাইকে শীতের পিঠার নিমন্ত্রণের পালা নানা অনুষঙ্গে যোগ হয়েছে। দিনে দিনে এর পরিধি বেড়েছে। বাঙালির পিঠা এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশ বিভুঁইতে পৌঁছেছে। বিশ্বের দেশে দেশে শীতকাল আসে, তবে বাঙালির শীতকাল পিঠা ছাড়া একেবারেই বেমানান। শীত আসবে, উনুনে পিঠা চড়বে না তা কি হয়! বর্তমান সময়ে শুধু পিঠাকে কেন্দ্র করে উৎসব আয়োজন হয় শুধু আমাদের আবহমান সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে সবার মাঝে তুলে ধরার জন্য।
ঢাকাসহ সারাদেশেই শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় পিঠা উৎসবের প্রস্তুতি। বিভিন্ন জায়গায় পিঠা উৎসবের আমেজ নিয়ে বাহারি, মজাদার পিঠা খাওয়ার জমজমাট আয়োজন করা হয়। পাটিসাপটা, দুধকুলি, ভাজাকুলি, নারিকেলি, ভাপা, চিতই, নকশিপিঠা ইত্যাদি। শীতে দুধে ভেজানো পিঠা কার রসনাকে উসকে না দেয়! একসময় পিঠা ছিল গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখন তা শহরের বিলাস খাদ্যে নাম লিখিয়েছে। ফুটপাত থেকে নামি-দামি খাদ্যভা-ার এখন দেখা যায় পিঠার বিশেষ মেন্যু, বিশেষত শীতকালে। একসময় পিঠার পাশাপাশি মোয়া, মুড়কি, লাড্ডু, বরফি ছিল প্রায় অনিবার্য পদ।
বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে একসময় শীতকালে অনেক ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এ সময় গ্রাম-বাংলায় শীতসন্ধ্যায় কেচ্ছা বলার ধুম পড়ত। জারি, সারি, বাউল, হাছন রাজার গানের আসর বসত পাড়ায়-পাড়ায়। পাঠের সুর হিমেল বাতাসে ছড়িয়ে পড়ত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। পৌষের জ্যোৎ¯œায় উঠানে-উঠানে বসত ‘বিষাদ সিন্ধুর’ পাঠের আসর, রাতভর মারফতি, মুর্শিদী গানের সেই শীত তাড়ানো আনন্দ এখন বিরল। এখন আর শীতের মধ্যরাতে কবিয়ালদের ঢাক-ঢোলক ছন্দে মুখর হয় না। একসময় উত্তর বাংলার গম্ভীরা গান ছিল শীত ঋতুর প্রধান বিষয়।

গ্রাম-বাংলার শীত সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বিষয় ‘যাত্রাপালা’ এবং ‘নাটক।’ শীতের শুরু থেকে সাড়ম্বরে চলত আয়োজন। পাড়ায়-পাড়ায় জমে উঠত যাত্রা-নাটকের রিহার্সেল। খড়ের বিছানায় বসে রাতভর যাত্রা দেখত দর্শকরা। আজকাল যাত্রাপালা নেই বললেই চলে। কিছুটা শহুরে আদলে নাট্য মঞ্চস্থ হয়। এই শীতের দাপট ও কিছুটা রুক্ষতার কথা বাদ দিলে শীত আমাদের সবার কাছেই প্রিয় ঋতু। এই ঋতুতে আমরা নিজেদের সাজাই অন্যরূপে। এই সময়টাতে গোলাপ, বেলী, গাদা, চন্দ্রমল্লিকা, বকুল, চামিলীর সৌরভ ও সৌন্দর্য ফুটে ওঠে শীতের ছোঁয়ায়।

দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ তখন ভরে ওঠে শর্ষে ফুলের হলুদ আভায়। মনে হয় সারা মাঠে বুঝি হলুদ গালিচা পাতা। হলুদ শাড়িতে রাতের কুয়াশা ভিজিয়ে দিচ্ছে রমণীকে। কেশের শিউলি ফুল যেন তাজা হয়ে রাজত্ব করছে পুরো সময়কে। হলুদ, লাল আর কমলা রঙের শাড়িতে নিজেদের হেমন্তের সাজে সজ্জিত করেছে। হাতের মুঠোফোনে সেলফি আর ক্যাপশনের মধুরতার নৃত্যে মেতে উঠেছে ফেসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রাম। এক সময় পাতা ঝরা ন্যাড়া গাছ জেগে ওঠে নতুন প্রাণের সঞ্জীবনে। তারপর শীত পেরিয়ে হাজির হয় ঋতুরাজ বসন্ত।

লেখক : সংস্কৃতি কর্মী

×