ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফোনে আড়িপাতার যৌক্তিকতা

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

ফোনে আড়িপাতার যৌক্তিকতা

ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে আইনসম্মতভাবে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে

ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে আইনসম্মতভাবে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য একটি ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম লফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইএলআইএস) চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বিশ্বের অনেক দেশেই ফোনে আড়িপাতার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সময় আড়িপাতার বিষয়ে অভিযোগও পাওয়া যায়। তবে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ফোনে আড়িপাতার ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না।

এক্ষেত্রে সরকার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে একটি অভিনব বিষয়ের অবতারণা করেছে। আড়িপাতার বিষয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পক্ষে-বিপক্ষে মতামত চলে আসছে। কেউ বলছেন, ফোনে আড়িপাতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আবার কেউ কেউ বলছেন, সরকার প্রয়োজন সাপেক্ষে জননিরাপত্তার স্বার্থে ফোনে আড়িপেতে ঘৃণ্য অপরাধীদের গ্রেফতার করে জনমনে স্বস্তি ও বিশ্বাস স্থাপন করতে বদ্ধপরিকর। 
একজন সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে প্রচলিত আইনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ তিনি জানান, ‘গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতাবাদ, জঙ্গিবাদ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখতে দৃঢ় অবস্থান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।’

ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করতে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি), ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে এবং একটি ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম লফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইএলআইএস) চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, আইএলআইএস হচ্ছে আইনসম্মতভাবে নজরদারির ব্যবস্থা। কাজেই আইনসিদ্ধ উপায়ে জনগণের কল্যাণার্থে সরকার যদি কোনো কল্যাণকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে জনসাধারণের কোনোরূপ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। 
সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকা-ের অভিযোগ পাওয়া যাবে, পরবর্তী সময়ে কোনোরূপ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাকে ধূলিসাৎ করার মানসেই ফোনে নজরদারির বিষয়ে বলা হয়েছে। এখানে কোনো নিরপরাধ মানুষ বা সাধারণ জনগণ কোনোভাবেই হেনস্তার মুখোমুখি হবে না এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

তবে এ ব্যাপারে যদি কোনোরূপ অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ করে রাজনৈতিকভাবে প্রতিশোধপরায়ণ হওয়ার মনোবৃত্তি জাগ্রত হয় সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে মানুষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হবে। যেহেতু বিষয়টি নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে সেক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় হলে সরকারের ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে। 
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭ (ক) (১) ধারা বলছে, ‘এ আইনে বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে এবং উক্ত কাজে সার্বিক সহায়তা দেওয়ার জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে।’

এই ধারার উপধারা ২-এ বলা হয়েছে, এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘সরকার’ বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝাবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে। তাই বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার প্রয়োজনে আড়িপাতার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে?
ভারতের একটি ঘটনা- চোস্ত পাঞ্জাবিতে বলা কথাটা শুনেই প্রথম খটকাটা লেগেছিল ফোনে আড়িপাতা গোয়েন্দাদের। এপাশ থেকে ছেলে বলছে, ‘ম্যায় কুরবানি দেনে যা রহা হুঁ’। উল্টোদিক থেকে ঠা-া গলায় মা বললেন, ‘পহলে খা লো, ফির যো করনে গিয়া ওহ করো’।

গোটা বাক্যালাপ মাত্র ৪০ সেকেন্ডের। কিন্তু তা শুনেই শোরগোল পড়ে যায় পাঞ্জাব প্রশাসনের অন্দরমহলে। খবর যায় দিল্লিতে। সতর্ক করা হয় সব পক্ষকে। আর তার জেরেই পাঠানকোটে বড়সড় জঙ্গি হামলা প্রতিহত করা হয়েছে বলে দাবি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। ভোররাত থেকে মোট ১৬ ঘণ্টা যে লড়াই চলল পাঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে তাইবা কম কী! দিনের শেষে চার জঙ্গিকে নিকেশ করা গিয়েছে বলে জানিয়েছে বায়ুসেনা সূত্র।

প্রাণ গেছে তিন জওয়ানেরও। তবে আগাম খবর পেয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় জঙ্গিদের বায়ুসেনা ঘাঁটির লঙ্গরেই (খাওয়ার জায়গা) আটকে ফেলা গিয়েছিল বলে সেনাসূত্রের দাবি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তৎপরতার জেরেই সেদিন বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে পাঠানকোট।
 শুধু ভারতে নয়, যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশে গোয়েন্দারা সন্দেহভাজনদের ফোনকল জব্দ করে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করেছে। বিষয়গুলো খুব বেশি আলোচনায় না আসায় মানুষ তেমন এ বিষয়ে জানতেন না। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভাবনের কারণে সরকারের নজরদারির বিষয়গুলো মানুষ টের পেয়ে যাচ্ছে এবং এ সকল বিষয়ে অবগত হচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের কথোপকথন রেকর্ডের ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে আসে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যত্রতত্র মানুষের ফোনালাপ রেকর্ড করার কোনো মানে হয় না। যে বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব প্রদান করে ফোনে নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। কিংবা দেশের অভ্যন্তরীণ গোপন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোর তথ্য কোনোভাবেই পাচার করা সমীচীন নয়।

এমন কার্য যারা সম্পাদন করে থাকে কিংবা যাদের নিয়ে সন্দেহ রয়েছে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের ফোনকলে আড়িপাতা যেতে পারে। কিন্তু যিনি কোনোভাবেই রাষ্ট্রবিরোধী কোনোরূপ কর্মকা-ে সম্পৃক্ত নন, যার দ্বারা রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে এমন প্রমাণসহ তথ্য নেই তার ফোনে আড়িপাতা হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার সৃষ্টি করবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে।  
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘এখন যে বিধান রয়েছে অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে বিশেষ ব্যক্তি, যারা জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত তাদের নজরদারি করা যায়। এর বাইরে গিয়ে যদি কাউকে নজরদারি করতে আড়িপাতা হয় সেটি অবশ্যই বেআইনি। আর আইন করে যে আড়িপাতার বৈধতা দেওয়ার কথা উঠেছে সেটি সঠিক নয়। এটি গ্রহণযোগ্য হবে না।’ তার মতে, সরকার শেষ পর্যন্ত সেই পথে হাঁটবে বলে মনে হয় না। একেবারে ঢালাওভাবে ফোনে আড়িপাতার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়নি।

জননিরাপত্তার স্বার্থে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফোনে আড়িপাতার বিষয়ে বা নজরদারির বিষয়ে সাধারণ মানুষেরও সমর্থন থাকবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, সন্ত্রাসবাদে অর্থ সহায়তা প্রদানকারী কাউকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে যথার্থ প্রমাণের জন্য ফোনে নজরদারি করা হলে কিংবা নারী পাচারকারী হিসেবে কারও বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রমাণ পেলে, অধিকন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোনে নজরদারির বিষয়ে সাধারণ মানুষের সমর্থনও থাকবে। রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সম্পৃক্ত নয় এমন কাউকে হয়রানি করা হবে না- এমনটি নিশ্চিত করেই সরকারের এ পথে হাঁটা উচিত।  
তবে সরকারের উচিত হবে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ করে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িকতার উসকানি, গুজব সৃষ্টিকারী ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণসহ রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে আড়িপাতার বিষয়ে সরকার ভূমিকা নিতে পারে। প্রকৃত অর্থে যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আইএলআইএস প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে উদ্দেশ্যটি নিতান্তই দেশের মঙ্গলের জন্য। সরকার যদি এ বিষয়ে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অযাচিত হয়রানির শিকার হবে না।

কিন্তু যারা সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে রাজনীতি করে, সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়, গুজব রটায়, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে, দেশের তথ্য বাইরে পাচার করেÑ এসব ক্ষেত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের যথার্থ প্রমাণসাপেক্ষে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। তবে সাধারণ জনগণের বাকস্বাধীনতা কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই সরকারের জন্য শোভনীয় হবে না। আমরাও আশা করি সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হোক এমন ব্যবস্থা কখনোই সরকার গ্রহণ করবে না।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে আইএলআইএস প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হবে মর্মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন সে সকল উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সরকারকে এ প্রযুক্তি আনাসহ ব্যবহারে সাধুবাদ জানাবে।  
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

×