ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেপরোয়া চালকে বাড়ছে  সড়ক দুর্ঘটনা 

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩০, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

বেপরোয়া চালকে বাড়ছে  সড়ক দুর্ঘটনা 

ব্রিটিশ আমলের আইনে গাড়ি চালানো অবস্থায় ইয়ার ফোন চালানো নিষেধ ছিল

সংগীতে গুরুমুখী বিদ্যার কথা জানা থাকলেও গাড়ি চালানোয় এ বিদ্যার কথা অনেকের জানা ছিল না। আজকাল সিরিজ দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসছে চালকের গুরুমুখী বিদ্যার কথা। তবে সংগীতে সাত স্বরে হাতেখড়ি তারপর দীর্ঘ সময় প্রায় জীবনজুড়ে সাধনা চলে। মোটরযান শাস্ত্রে সাধনা বলে কিছু নেই। স্টিয়ারিং, এক্সিলেটর, ব্রেক, গিয়ার ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হলেই গাড়ি নিয়ে সোজা রাস্তায়। শহরে কিছুদিন চালানোর আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারলে হাইওয়ে। এরপর দুর্ঘটনার নায়ক বা ভিলেন হয়ে আলোচনায় আসা। দুর্ঘটনার অনুঘটক হিসেবে তাদের দিকেই থাকে অভিযোগের আঙ্গুল। 
সত্যিই কি সড়ক দুর্ঘটনার মূল দায় চালকের? হ্যাঁ, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে চালকের অদক্ষতার জন্যই হয়। কিন্তু অদক্ষ চালক স্টিয়ারিং ধরছে কেন? তাদের পেশাগত সঠিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কেন? বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) বৈধ ছাড়পত্র নিয়ে সারাদেশে গাড়ি চালাচ্ছে দশ লাখের বেশি চালক। আর বৈধ ছাড়পত্রে গাড়ি চলছে চৌদ্দ লাখের বেশি। সরকারী হিসাবেই অবৈধ চালক পাঁচ লাখের বেশি। বেসরকারী হিসেবে সংখ্যা আরও বেশি হবে নিঃসন্দেহে।

বৈধ ছাড়পত্রহীন এসব চালকের একমাত্র ভরসা গুরুমুখী বিদ্যা। আর এদের হাতে জীবন সঁপে মানুষ রাস্তায় চলছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে ট্র্যাজেডি। ক’বছর আগে মিরসরাইয়ে চুয়াল্লিশ স্কুলছাত্রের মৃত্যুতে আলোড়িত হয়েছিল দেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী সজল চোখে স্বজনহারাদের সান্ত¡না দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘটনা তদন্ত করে চালককে শাস্তি দিতে বলেছিলেন। এ সড়কে এ ধরনের হৃদয়বিদারি ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের দুতিন দিনের মধ্যে চালক গ্রেপ্তার হয় এবং বাস্তবতা স্বীকার করে আবার সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছিল মিরসরাইয়ের ওই সড়কে। এত নিয়মিত ঘটেছে এগুলো যে, একে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, নিয়মিত ঘটনাই হয়েছে যেন। কদিন আগে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে এ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় মা ও মেয়ের মৃত্যুর হৃদয় বিদারক খবর নাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মন। ভারি যানবাহনের ধাক্কায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। একেবারে সম্প্রতি, গত রবিবার সদ্য নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে বাসের ধাক্কায়। অভিযুক্ত বাসটি অতীতেও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। মামলা হওয়ায় নাম বদলে অন্য নামে চলছে। কিন্তু অদক্ষ চালকের জায়গায় আসেনি দক্ষ চালক।
মিরসরাই ট্র্যাজেডির চালক সেসময় গ্রেপ্তার হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বেঘোরে অত প্রাণ নষ্ট করার জন্য তার শাস্তি হয়েছিল তিন বছরের জেল ও দশ হাজার টাকা জরিমানা। বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চালক জামিন পায়। সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আইনেই এ সুযোগ রয়েছে। এ আইন পাস হয়েছিল ১৮৬০ সালে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল সাত বছরের কারাদ-। ১৯৮৫ সালে এক অধ্যাদেশে তা প্রথমে পাঁচ এবং পরে তিন বছর করা হয়। একজন মারা গেলে চালকের যে শাস্তি একশ’ জন মারা গেলেও তাই। 
এ আইন পাস হয়েছিল ১৮৬০ সালে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল সাত বছরের কারাদ-। এরশাদ সরকারের সময় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ও জামিন অযোগ্য ধারা যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু চালকদের আন্দোলনের মুখে কয়েক মাসের মধ্যে শাস্তির ধারা বাতিল করে পুরনো ধারায় ফিরে যায়। একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে এরপর সাজার মেয়াদ আরও কমানো হয়। এ প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি এক অধ্যাদেশ জারি করেন। তাতে সাজার মেয়াদ সাত বছর থেকে নামিয়ে পাঁচ বছর করা হয়। এ প্রসঙ্গে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর কর্ণধার ইলিয়াস কাঞ্চন একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যে আইন রয়েছে তাকে চালকরা কিছুই মনে করে না। কেউ কেউ পাত্তাই দিতে চায় না।

তারা জানে, দুর্ঘটনা করলেও তাদের বেশি শাস্তি হবে না। ১৯৯২ সালে সাবেক এক মন্ত্রীর ছেলে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। নিজের ছেলেকে বাঁচাতে ওই মন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের শাস্তি কমানোর বিল উত্থাপন করেন এবং সংসদে বিল পাস হয়। দু’শ’ ঊনআশি ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর করা হয়। আমি বলব, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আজকে সবচেয়ে বেশি দায়ী ওই সাবেক মন্ত্রী। যিনি নিজের ছেলেকে বাঁচাতে সর্বনাশ করে গেছেন। ব্রিটিশ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল দশ বছর সশ্রম কারাদ- ও জামিন অযোগ্য অপরাধ। এরশাদ সরকার এ শাস্তি বাড়িয়ে চৌদ্দ বছর করে।

তখন পরিবহন শ্রমিকরা আন্দোলন করে শাস্তি পাঁচ বছরে নামায়। মন্ত্রীর ছেলের ঘটনা এর পরের। আগের আইনটি কেন ফিরিয়ে আনা হবে না জানতে চেয়ে উচ্চ আদালত থেকে একটি রুলও জারি করা হয়েছে। কিন্তু সরকার কী জবাব দিয়েছে, তা আমার জানা নেই।’
কিন্তু শুধু আইন করেই কি দুর্ঘটনা বন্ধ করা যাবে? ব্রিটিশ আমলের আইনে গাড়ি চালানো অবস্থায় ইয়ার ফোন চালানো নিষেধ ছিল। সমসাময়িক বাস্তবতা বিবেচনা করে ১৯০৭ সালে বিআরটিএ আইনের ধারা সংশোধন করে ইয়ার ফোনের সঙ্গে মোবাইল ফোন ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে। অমান্য করার শাস্তি এক মাসের কারাদ- অথবা পাঁচশ’ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। 
কিন্তু কে শুনছে কার কথা? গাড়ি চালাতে চালাতে সেলফোনে কথা বলা এখন পরিচিত দৃশ্য। বেশিরভাগ দুর্ঘটনা হয় ফোনে কথা বলতে বলতেই। ক’বছর আগে জনকণ্ঠের মানবসম্পদ বিভাগের সোহেলী আক্তার শম্পা ও তার স্বামীকে চাপা দেওয়া বাসের চালকও সেলফোনে কথা বলতে বলতে দুর্ঘটনা ঘটায়। অন্তঃসত্ত্বা সোহেলী এবং তার স্বামী দুজনেরই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয়। এসব দুর্ঘটনায় অসংখ্য পরিবার চাপা কান্না বয়ে বেড়ায় আজীবন। 
গত দশ বারো বছরে যানবাহন বেড়েছে চার গুণের বেশি। এর মধ্যে শতকরা আশি ভাগ গাড়ির ফিটনেস নেই। 
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতি হয় বছরে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। আরেকটি প্রতিবেদনে ক্ষতির পরিমাণ পাওয়া গিয়েছিল একশ’ ছিয়াত্তর কোটি টাকার। 
বেশিরভাগ দুর্ঘটনার মামলা হলেও ঠিকমতো তদন্ত হয় না। দুর্ঘটনার পর চালককে শনাক্ত করতে পারে না পুলিশ। করলেও অনেক সময়ই নেপথ্য কারণে ঘটনা চেপে যান তদন্ত কর্মকর্তারা। 
ঝামেলা এড়াতে সাধারণত নিহতের পরিবার পুলিশের কাছে যায় না। মামলা করলেও তার খোঁজ রাখে না। তদন্তকারী কর্মকর্তারাও ছয় মাস এক বছর ফাইলবন্দি রেখে মামলা তামাদি করে দেন। কখনো কখনো অজ্ঞাত আসামি এবং চালককে দায়ী করে এবং চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয়। কিন্তু তাতেও নানা রকম অসঙ্গতি ও দুর্বলতা থাকে। ফলে বিচারিক আদালতে আসামি সহজে পার পায়। সড়ক দুর্ঘটনা আইনেই গলদ থাকায় চালক বা আসামির তেমন কিছু হয় না। 
দুর্ঘটনা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) সড়ক দুর্ঘটনার ওপর গবেষণা চালায়। তাতে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ দুর্ঘটনা হয় বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে। নিহতদের শতকরা আশি ভাগের বয়স পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে। তিপ্পান্ন ভাগ পথচারী, যাদের মধ্যে শতকরা একুশ ভাগের বয়স ষোলো বছরের নিচে। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মারা যায় দুর্ঘটনার পনেরো মিনিটের মধ্যে। মস্তিষ্ক বা হৃদযন্ত্রে বড় ধরনের আঘাত ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এসব মৃত্যুর মূল কারণ। পঁয়ত্রিশ ভাগ মারা যায় এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে। সাধারণত মাথা ও বুকে আঘাতে এ মৃত্যু হয়। বাকি পনেরো ভাগ মারা যায় দুর্ঘটনার এক মাসের মধ্যে। বিশেষ কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হওযায় এরা মারা যায়। 
এআরআইয়ের তথ্যমতে, সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় বারো লাখ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এর শতকরা নব্বই ভাগই হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। মোট দুর্ঘটনার অর্ধেকের শিকার এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। দুর্ঘটনার শিকার মানুষের চিকিৎসার জন্য এসব দেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা এক থেকে পাঁচ ভাগ খরচ করতে হয়। 
সরকারিভাবে বছরে প্রায় চার হাজার দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান থাকলেও আসল সংখ্যা তার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। দুর্ঘটনার জন্য বছরে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয়। 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষিত চালকের অভাব, পথচারীর অসতর্কতা, ফিটনেস ঠিক না থাকা, অতিরিক্ত গতি, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, অতিরিক্ত গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সেতু এবং অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া জাতীয় স্থল পরিবহন ও মহাসড়ক বিধিমালা ২০০১সহ বিভিন্ন নীতিমালার বাস্তবায়ন না হওয়া, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের অকার্যকর অবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও সামাজিক আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

×