ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার দিনরাত

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ২০:৫২, ৫ ডিসেম্বর ২০২২

ঢাকার দিনরাত

সড়ক দুর্ঘটনা ঘটালে জনতা এককাট্টা হয়ে ওই গাড়ি ভাঙচুর ও তার চালককে ধোলাই দেওয়ার কাজে নেমে পড়ে

দেখতে দেখতে পাঁচ বছর চলে গেল! গত বুধবার ছিল ঢাকার সাবেক মেয়র আনিসুল হকের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। সেদিন কাগজে তার পুত্র নাভিদুল হক বাবাকে নিয়ে লিখলেন। তার লেখা এই কথাগুলো হৃদয় ছুঁয়ে গেল। লিখেছেন : ‘একদিন শুক্রবার দুপুরে খাওয়ার আগে তিনি বাসায় বসে ফাইল সই করছিলেন, আমি একটু রাগই হলাম। শুক্রবার একটা দিন আমরা পরিবারের সবাই একসঙ্গে একটু বসি একবেলা খাওয়ার জন্য। তা-ও মাত্র ঘণ্টা দুই-তিনের জন্য, এর ভেতর আবার ফাইল সই করা!

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নাভিদ আমি আমার জীবনে এত পরিশ্রম করিনি। জীবনে একেবারে নিচ থেকে উঠে এসেছি, নিজ হাতে সব তৈরি করেছি, কিন্তু এত পরিশ্রম আমাকে করতে হয়নি, যা এখন শহরের জন্য করছি!’ বাবাকে দেখে মনে হলো তিনি অনেক ক্লান্ত, একটু চিন্তিত। তিনি বাসায় যে পরিকল্পনাগুলো করছেন আগামীর ঢাকার জন্য, সেই কাজগুলো কি করতে পারবেন?’

মর্মান্তিক ও অমানবিক

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় ওই বিশ^বিদ্যালয়েরই সাবেক এক শিক্ষক তার ব্যক্তিগত গাড়ির নিচে আটকা পড়া নারীকে টেনে-হিঁচড়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। শুরুতে একটু অন্যরকম কয়েকটি কথা বলতে চাইছি। সচরাচর এমন যুক্তিনিষ্ঠ খোলামেলা কথার ধার কেউ না ধারলেও বিদেশে, মানে উন্নত দেশগুলোয় কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটালে ওই দুর্ঘটনাস্থলেই গাড়ি থামিয়ে রাখতে বাধ্য হন ট্রাফিক আইনের যথাযথ শাসন থাকার কারণেই।

পুলিশের গাড়ি এসে প্রাথমিক তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ করার পর গাড়িচালক বাড়ি বা আদালতে ফিরতে পারেন। তার মানে এই নয় যে তিনি দোষী হলে একেবারে রেহাই পেয়ে যান। আইন অনুযায়ী তার দ- নির্ধারিত হয়। তাছাড়া গণপিটুনির মতো পরিস্থিতিতেও ওই গাড়িচালককে পড়তে হয় না। কোনো দুর্নীতি কিংবা প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ বিনা সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সংস্কৃতি বেগবান থাকলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা হয়তো এড়ানো যেতো।

তাহলে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে নিজের গাড়ির নিচে আটকে পড়া মানুষের কথা না ভেবে গাড়ি হাঁকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নাও ঘটতে পারত। আমরা তো আমাদের অভিজ্ঞতায় অহরহ দেখছি যে কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটালে জনতা এককাট্টা হয়ে ওই গাড়ি ভাঙচুর ও তার চালককে ধোলাই দেওয়ার কাজে নেমে পড়ে। তাই দুর্ঘটনা ঘটানোর পর ট্রাক ড্রাইভার হোক কি বাসচালক হোক, পড়িমড়ি পালিয়ে যান। এসব সত্যকে পাশ কাটিয়ে আমরা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার করতে সক্ষম হব না।
আসা যাক ঢাবির সুনির্দিষ্ট ঘটনায়। এমন দুর্ঘটনা ঘটানোর পর যে কোনো চালকই পালানোর কথাই ভাবতো দেশে বিরাজমান বাস্তবতার কারণে। কিন্তু গাড়িটি যেহেতু চালাচ্ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল গাড়ির নিচে আটকে থাকা জীবিত মানুষকে তিনি টেনে নিয়ে মৃত্যুমুখে ফেলবেন না। কিন্তু ঘটনা ছিল ভিন্ন। একইসঙ্গে মর্মান্তিক ও অমানবিক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। একটি লেখা মানুষের মনে ধরেছে বলেই সেটি বহুজন শেয়ার করছেন। সেই লেখা থেকে এখানে কিছুটা অংশ তুলে দিয়ের পাঠকের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যিনি লিখেছেন তিনি ছিলেন ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী।
‘রুবিনা আক্তারকে এক কিলোমিটারের বেশি রাস্তা টেনে নিয়ে গাড়িটা যখন নীলক্ষেত মোড়ে থামল, সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে আপনার তখন কি আশা করা উচিত? তাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে পাঠানো এবং গাড়িসহ ড্রাইভারকে আটক করে উত্তম-মধ্যম দিয়ে পুলিশে দেওয়া। আমি এটা চাইতাম এবং আমি নিশ্চিত আপনারাও এটা চাইতেন। কিন্তু আমাদের চাওয়া এবং কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
সাইকেল নিয়ে প্রাইভেট কারের পিছু নিয়ে যখন নীলক্ষেত পৌঁছালাম ততক্ষণে উত্তেজিত জনতা গাড়ি থামিয়ে ভিক্টিমকে গাড়ির নিচ থেকে বের করে ফেলেছে। ড্রাইভারকে বের করে ধোলাই করছে জনতা। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে গালি দিচ্ছে আর একটা হলেও কিল ঘুষি লাথি মারার চেষ্টা করছে ড্রাইভার এবং গাড়িতে। এক বান্দা গাড়ির ছাদেও উঠে গেছে। লাথি দিয়ে দিয়ে উইন্ডশিল্ড আর উইন্ডো গ্লাস ভাঙায় ব্যস্ত সে। আর এই মারামারি ভাঙচুরের দৃশ্য ভিডিও করতে ব্যস্ত আরেক দল মানুষ।
সবাই এত ব্যস্ত, এত উত্তেজিত যাকে কেন্দ্র করে সেই রুবিনা আক্তার নিথরভাবে পড়ে আছে রাস্তার অন্য পাশে। শুধু হৃৎপিণ্ডটা ছটফট করছে।
তাকে ঘিরে ছবি তোলা আর ভিডিওতে ব্যস্ত একদল মানুষ, আরেকদল ব্যস্ত পকেটে হাত দিয়ে এক্সিডেন্টের দুঃখে হা হুতাশ করতে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এটা কারও মনে পড়ছে না। সবাই ভুলে গেছে।
সাইকেল নিয়ে ভিড় ঠেলে যতটুকু সম্ভব সামনে গিয়ে এক রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম মামা জলদি রিকশা আনেন! হাসপাতালে নেওয়া লাগবে। আমার মায়ের সেই ভাই, রিকশা পিছায়ে উল্টো দিকে চলে গেল। চিল্লায়ে যতই বলি কেউ একটা রিকশা ডাকেন, হাসপাতালে নেওয়া লাগবে, কেউ একটা ভ্যান ডাকেন। কেউই কথা কানে নেয় না। সবাই ব্যস্ত ভিডিও করতে। কয়েক মুহূর্ত পরে এক ভাই একটা ভ্যান নিয়ে আসল পিছন থেকে। ভ্যানে তুলে রুবিনা আক্তারকে নেওয়া হলো ঢাকা মেডিক্যালে। ইমার্জেন্সিতে তার সঙ্গে ছিল মাত্র একজন আপু। যিনি নিজেও র‌্যান্ডম একজন পথচারী।
ইমার্জেন্সি রুম থেকে যখন ইসিজি রুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম রুবিনা আক্তারকে, ঐ আপু কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বারবার। ইসিজি রুম থেকে রিপোর্ট নিয়ে ইমার্জেন্সি রুমে ব্যাক করার পরে যখন সার্টিফাই করল ‘শি ইজ নো মোর’,ঐ আপু আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন আরেকবার।
ইমার্জেন্সি রুমে আরেকজন ভাই ছিল। কথা বলার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম তিনি সাংবাদিক। আপুর থেকে, আমার থেকে বেশ কিছু তথ্য নিলেন। ভিক্টিমকে যখন ডেড ঘোষণা করা হলো তখনও তার ফ্যামিলির কেউ উপস্থিত নেই সেখানে। ওনার দেবর ছিলেন রক্তের খোঁজে বাইরে। আছি শুধু আমি আর ঐ আপু। আর দুই সাংবাদিক ভাই। রুবিনা আক্তারকে মৃত ঘোষণার পরেই এক সাংবাদিক ভাই আমাকে বললেন, ‘ভাই চলেন, এখানে আর থাকার দরকার নেই।’
আমি অস্বীকৃতি জানালে সে নিজেই বের হয়ে গেল। তার কাজ শেষ সেখানে। কালেক্ট করার মতো কোনো ইন্টারেস্টিং আর কিছু নেই।
এই যে মানুষের ব্যবহার; একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে ফেলে রেখে ছবি তোলা বা ভিডিও করা, এগুলো কিভাবে শুরু হলো? বা এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? আমার জানা নেই। আছে শুধু একরাশ খারাপ লাগা অনুভূতি।’ (মীর সাফায়ত হাসানের পোস্ট)
দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সঙ্গে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর কোনো তুলনা চলে না। পর্যবেক্ষক, সমাজতাত্ত্বিক ও মনোবিশ্লেষকদের ভেতর এই অবিশ্বাস্য ঘটনা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, পথচারীদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও গাড়িচালক তার গাড়ির নিচে আটকে থাকা নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পরিবর্তে কেন অমন বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে থাকেন। তিনি কি গণপিটুনির ভয়েই এমনটি করেছেন? তার বিবেক কেন সাড়া দিল না! বিচারবুদ্ধি লোপ পেল কেন? শেষ পর্যন্ত তো তিনি গণধোলাই থেকে রেহাই পেলেন না।

একদম শুরুতেই অর্থাৎ, মোটরসাইকেল গাড়ির ধাক্কায় যখন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলো এবং তার গাড়ির নিচে নারী আটকা পড়লেন, তখন গাড়ি না ছুটিয়ে থামালে ওই নারীর জীবন রক্ষা পেত। কিন্তু একজন সাবেক শিক্ষক হয়েও অন্যকে আহত তথা হত্যা করে হলেও নিজেকে রক্ষার তাগিদটিই তার কাছে কেন বড় হয়ে দেখা দিল! শিক্ষা মানুষকে নিশ্চয়ই উন্নত করে। দুঃখজনক হলো এক্ষেত্রে আমরা তেমন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে দেখলাম না।

এদেশের জনসংস্কৃতি, সাধারণ মূল্যবোধ, মানুষের সহজাত মানবিকতা এবং তাৎক্ষণিক করণীয় বিষয়ে সঙ্গত ভাবনা- এসব কার্যকর থাকলেই একটি জীবন রক্ষা পেতে পারত। পক্ষান্তরে সমাজে স্বেচ্ছাচারী বিবেকবর্জিত আচরণের দৃষ্টান্তও প্রতিষ্ঠিত হতো না। সড়কে অবিশ^াস্যভাবে যন্ত্রণাপিষ্ট হয়ে রুবিনার মৃত্যু সমাজের গভীর ক্ষতটিকে এক টানে প্রকাশ করে দিয়েছে। সেটি হলো মানুষ বড় স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তার নিজেরই ভুল বা অসতর্কতা কিংবা অপরাধের কারণে কেউ মহাঝুঁকির মধ্যে পড়লেও মানুষ নিজেকে বাঁচাতেই যেন মরিয়া। এই সামাজিক মহাঅবক্ষয় থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে সম্মিলিতভাবেই।

লেখকদের আনন্দ ভ্রমণ

শীত শুরু না হতেই এ এক মনোরম মজাদার যাত্রা। এটিকে লেখকদের পিকনিকও বলা চলে। আবার নৌভ্রমণও বলা যায়। দল বেঁধে কবি-সাহিত্যিকেরা ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন, দুদিন আনন্দ করে ফের ফিরে এলেন ঢাকায়। এর মাধ্যমে লেখকে-লেখকে যেমন সরসারি আলাপনে এক ধরনের নৈকট্য লাভ ঘটে, তেমনি পরবর্তীকালে লেখার প্রেরণা ও রসদও মেলে। অপরিচিত লেখককে চেনাজানারও সুযোগ বটে। তরুণ ও প্রবীণ কবি উভয়ে নিজের কণ্ঠে কবিতা শোনানোর সুযোগটিও কাজে লাগান।

বিষয়টি কিছুটা অভিনব, মানতেই হবে। হাসি, গান, কবিতা, রসিকতা, আড্ডায় নিঃসন্দেহে প্রাণের স্ফূর্তি প্রকাশ পায়। ষাট ছুঁইছুঁই এক লেখক এভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন : ‘মনপুরা, নিঝুম দ্বীপে ৩৬ ঘণ্টার এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এলাম রাজধানীতে। ৩৬ ঘণ্টায় ঘটল ৬৩ ঘণ্টার চেয়ে বেশি ঘটনা। প্রায় ২৫০ জন কবি-সাহিত্যিককে নিয়ে জলে ভাসল এম ভি মধুমতি। ঢাকা  থেকে মনপুরা, সেখান থেকে ট্রলারযোগে নিঝুম দ্বীপ। এরপর একই রুটে ফিরে আসা। লিখতে গেলে ছোটখাটো বই হয়ে যাবে।’

লাইলী মজনু

জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এবার ¯œাতকোত্তর পরীক্ষা প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে উপস্থাপন করেছে দৌলত উজির বাহরাম খাঁ রচিত কাব্য অবলম্বনে অতুল প্রেমের আখ্যান ‘লাইলী মজনু’। লাইলি-মজনুর প্রেম কাহিনির জন্ম ইরানে। এর সত্যাসত্য বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না। কিন্তু এরপরও সত্যের অধিক সত্যরূপে হাজার বছর ধরে এই অনুপম প্রণয়োপাখ্যান সুফি কবিদের রচিত স্তবকে অর্জন করেছে কালোত্তীর্ণের মহিমা।

ফার্সি ভাষার বেশ কয়েকজন কবি কাব্য সৃজন করেছেন এই কাহিনী অবলম্বনে। তাঁদের কাব্য পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলা ভাষার বেশ কয়েকজন কবিও নির্মাণ করেছেন আখ্যান। তবে প্রাচীনত্বের দিক থেকে দৌলত উজির বাহরাম খানই প্রথম বাংলা ভাষায় এই আখ্যান রচনা করেন। রুবাইয়াৎ আহমেদ তাঁর রচিত ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যের কাহিনী নির্যাসটুকু অবলম্বন করেই রচনা করেছেন মঞ্চনাটক ‘লাইলি-মজনু’।

নাটকটির পরীক্ষামূলক মঞ্চায়ন হলো এ সপ্তাহে শিল্পকলা একাডেমিতে। নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ বর্ণনাত্মক নাট্যময়তার যে স্বকীয় পথে চলছে তারই একটি নতুন পর্যায় ‘লাইলী মজনু’।

০৪ ডিসেম্বর, ২০২২
[email protected]

×