ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কূটনৈতিক শোভনীয়তা ও গণমাধ্যম

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

প্রকাশিত: ২০:৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২২

কূটনৈতিক শোভনীয়তা ও গণমাধ্যম

ঢাকার বিদেশী কূটনীতিকদের ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি’

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করার পরও জাতি হিসেবে আমাদের একাংশের নৈতিকতার দুর্বলতা লক্ষণীয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একমাত্র লক্ষ্যই ছিল দেশকে স্বাধীন করা এবং সাধারণ জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশ যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে, সেখানে একটি বিরোধী শিবির বরাবরই সর্বক্ষেত্রেই চরম বিরুদ্ধাচার অব্যাহত রেখে চলছে।

বিরোধী শিবিরে কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন ও অরাজনৈতিক নামধারী সুশীল সমাজের একটা বিশেষ অংশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রকারান্তে মূল স্রোতের বিপরীত ভাবধারা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। যদিও এ সকল অপশক্তি বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র পরিচালনারও সুযোগ পেয়েছিল অর্ধেকেরও বেশি সময়কাল। এখানেই নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী জোটগুলো কূটনৈতিক তৎপরতা ক্রমশ বৃদ্ধি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইইউ রাষ্ট্রদূত, মার্কিন রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক, ঢাকায় নিযুক্ত কানাডিয়ান হাইকমিশনার লিলি নিকোলাস, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিকটার ভেন্ডসেন, সুইডিশ রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্স বার্গ ফন লিন্ড, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করে বিএনপি।

আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও রুটিন করে এখন দূতাবাসগুলোতে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছে। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৪টি দেশের কূটনীতিক। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের ব্যাপক আগ্রহ বরাবরই দৃশ্যমান।
কূটনৈতিক বিষয়ে প্রত্যেকটি দেশের কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় রয়েছে। সেগুলোতে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা সবসময় দেখে আসছি এ বিষয়গুলো তখনই ঘটে, যখন রাজনৈতিক বিভক্তি দেখা দেয়। তখন কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কিছু গোপন বিষয় বিদেশীদের জানিয়ে দেয়। এটি খুবই অশুভ লক্ষণ। তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে চাপ সৃষ্টি করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিদেশীরা কথা বলছেন প্রায়ই। এটি কোনোভাবেই ভালো বিষয় নয়।

কাক্সিক্ষত তো নয়ই। নির্বাচন এলেই আন্তর্জাতিক মাধ্যম থেকেও কিছু কথা আসে। সেটি অতীতেও হয়েছে, এবারও হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই বিদেশীদের আমাদের দেশীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। বাংলাদেশের কিছু নিজস্ব বিষয় রয়েছে। সেটি দেশের জনগণই ঠিক করবে। আমরা দেখেছি, ভারত-ফিলিপিন্সসহ অনেক দেশেই অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। কিন্তু সেখানে বিদেশীরা তেমন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। নেই অন্যান্য দেশ নিয়েও। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে অনেক দেশের যেন ঘুম নেই।

এক্ষেত্রে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বিদেশীদের কাছে নালিশ বা সহায়তা চাওয়ার অতীত অভ্যাস থেকে বের হতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্য প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনগণ কী চায়, তা দেশের নাগরিকরাই ঠিক করবে। যেমন- অতীতেও আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি নিয়ে অনেক দেশ বিরোধিতা করেছে। আবার কেউ পক্ষেও ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ভালো-মন্দ বাংলাদেশকেই ঠিক করতে হয়েছে। এখন বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে এ রকম তৎপরতা কোনোভাবেই কূটনীতিকদের শোভনীয় নয়।
ঢাকার বিদেশী কূটনীতিকদের ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি’ মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে সরকার। ঢাকার সব দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে এ সংক্রান্ত অভিন্ন নোট ভারবাল পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ ও কাজে কূটনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তদের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার নীতি পুরোপুরি মেনে চলা উচিত। আমাদের দেশের নির্বাচন বা সংকটের দায় দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর।

এখানে অন্য কারও অযাচিত হস্তক্ষেপ কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে কোনো দেশের কূটনীতিকদের আচরণগত একটা সীমারেখা আছে। আবার প্রতিটি দেশেরও নিজস্ব একটা স্বকীয়তা আছে। সবটাই বিবেচনার মধ্যে থাকবে, আমাদের প্রত্যাশা এমনটাই।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে আগে থেকেই বিদেশী কূটনীতিকদের সতর্ক করা হয়েছে যে, সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের কোনো হস্তক্ষেপ দেখতে চায় না। কেননা, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করতে গিয়ে বিদেশী কূটনীতিকরাও দেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। সরকারি দল এবং বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দল যদি দায়িত্বশীল হয়, তবে বিদেশীদের নাক গলানোর কোনো সুযোগ থাকে না।
একজন পেশাদার কূটনীতিক শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তিনি ২০১৮-এর নির্বাচন সম্পর্কে শুনেছেন। শোনা কথার ওপর প্রকাশ্যে মন্তব্য করাটা অপেশাদার অবশ্যই। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে করা মন্তব্যে বিব্রত বাংলাদেশ সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যে রাষ্ট্রদূতকে বঙ্গবন্ধু পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে, এমন একজন পেশাদার কূটনীতিকের কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য সরকার আশা করেনি। এই উক্তি আমাদের মনে হয় একান্ত রাষ্ট্রদূতের এবং তিনি সাংবাদিকদের প্ররোচনায় বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণের জন্য নিন্দা জানিয়েছেন।
আমরা দেখতে পাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেদেশে বিনা বিচারে বিরোধীপক্ষকে কারা অন্তরীণ করে রাখছে এবং উল্লেখযোগ্য মার্কিন নাগরিককে প্রতিনিয়ত হত্যা করা হচ্ছে। সর্বশেষ সেদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে ক্যাপিটাল হিল দখলের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা এবং হত্যাকা- ঘটিয়ে বিশ্ববাসীকে উৎকণ্ঠিত করেছেন। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও সেদেশের কূটনীতিকরা আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অহরহ মন্তব্য করে থাকেন। এটা স্ববিরোধী আচরণ।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই দেশ কখনো কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবে না। দেশের মর্যাদা যে কোনোভাবে ধরে রাখতে হবে। সংবিধানের ১২৬ ধারায় উল্লেখ আছে, নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। জাপানি রাষ্ট্রদূতকে নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করতে বিএনপিও অনেকটা প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূতের করা মন্তব্যের দায় শুধু তার নয়। কূটনীতিকদের নানাভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে গত চার বছরে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের কোনো অভিযোগই করেনি জাপান সরকার। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও উষ্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ।
করোনা এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রশংসনীয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে চোখে দেখার মতো। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর-মাতারবাড়ী প্রকল্পসহ অসংখ্য প্রকল্প বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এগুলো উন্নয়নের নতুন ধাপে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রকল্পের সঙ্গে জাপান সরকার কাজ করছে। এর মধ্যে মেট্রোরেল লাইন-৬ উদ্বোধন হবে ডিসেম্বরে। এটি একটি মাইলফলক প্রকল্প। এছাড়াও বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, গভীর সমুদ্র প্রকল্প পাতাল রেল, আড়াইহাজার অর্থনৈতিক জোনসহ অনেক বড় বড় প্রকল্পে জাপান সহায়তা দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিয়েছে জাপান। রাখাইন রাজ্যে ৬৪ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিয়েছে প্রত্যাবাসন সহজ করতে। বাংলাদেশ ৫০ বছর পার করছে। জাপানের সঙ্গেও সম্পর্ক ৫০ বছর চলছে। অন্ততপক্ষে ৩১০টি জাপানি কোম্পানি দেশে কাজ করে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার মতো আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করতে চায় জাপান।
বাংলাদেশের এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলা। সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা, যাতে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। এ বিষয়ে পশ্চিমাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাদের আগ্রহের জায়গা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ডলার, ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান ও সমরাস্ত্র বাণিজ্য। আমরা উন্নত দেশগুলোর মধ্যেও গণতন্ত্রের ঘাটতি দেখতে পাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে তাকালেও এর প্রমাণ মেলে।

উন্নয়নশীল দেশে সামান্য ঘাটতি দেখলেই উন্নত দেশগুলো সেই দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার ক্রমাগত চেষ্টা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা প্রত্যক্ষ হয়েছে বরাবরই। আমাদের দেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন থাকার কারণে এ সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকে। সে অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।
 
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং চেয়ারম্যান, প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি

×