ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একজন সফল মেয়র

মোহা. হাবিবুল ইসলাম সুমন

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ২৭ নভেম্বর ২০২২

একজন সফল মেয়র

.

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত সফল মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সফল সভাপতি। ১৯৪৪ সালে ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ। শিশু হানিফ ছোটবেলায় মমতাময়ী মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর ফুফু আছিয়া খাতুনের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আর আদর্শে বেড়ে ওঠেন মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৬৭ সালে মাজেদ সরদার প্রিয়কন্যা ফাতেমা খাতুনকে মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বিয়ে দেন। এই দম্পতির একজন পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। পুত্র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত পূর্ণ মন্ত্রী মর্যাদায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন।

মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও তাঁর পরিবারকে মন্ত্রিপাড়ার বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সরকার। সে সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পরিবারে পুরান ঢাকার ৭৯ নম্বর নাজিরা বাজার বাসায় অবস্থান নেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। ১৯৬৫ সালের বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয়দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয়দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরে মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনে তিনি রাজপথে সংগ্রামের প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সম্মোহনী বাগ্মিতা তাকে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি এবং ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের মহান দায়িত্ব পালন করেন। সংগ্রামী জীবনে ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ৩০ বছর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দলের প্রতি অনুগত ও প্রিয় নেত্রীর বিশ্বস্ততায় এই মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ।
মোহাম্মদ হানিফের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে ইতিহাসের বর্বরোচিত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রায় সব সদস্যের নির্মম হত্যাকা-। এই হত্যাকা- কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি মোহাম্মদ হানিফ। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের হত্যাকা- মোহাম্মদ হানিফকে বেদনার গভীর সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে লন্ডনে একসঙ্গে সফরে থাকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ‘আমার যদি কিছু হয়ে যায় তুই আমার রাসেলকে দেখবি’ বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে করত মোহাম্মদ হানিফ। তাই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের পর মোহাম্মদ হানিফের কণ্ঠে ছিল শুধুই স্লোগান ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম মুজিব হত্যার বদলা নেব, রাসেল হত্যার বদলা নেব’ ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাজনৈতিকভাবে পিতা মুজিব হত্যার বদলা নেওয়া এবং হত্যার বিচারের দাবিতে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হয়েছিলেন মোহাম্মদ হানিফ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাথ উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানম-ি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকাবাসী সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলী বাতি স্থাপন, নগর সৌন্দর্য বর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন মেয়র হানিফ। নারী শিক্ষা বিস্তারে লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ।

এছাড়াও মহিলাদের মাতৃকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ করেন। শিশুবান্ধব ঢাকা গড়তে নিরলস কাজ করেছেন নগরপিতা হানিফ। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য পৌর শিশুপার্ক নির্মাণ ও পুরনো পার্কগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনা, এছাড়াও বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে গেছেন।  মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঢাকাবাসীর কষ্ট লাঘব করতে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা, মশক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার আমলে তিলোত্তমা নগরী গড়ার লক্ষ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়েও মহানগরীর উন্নয়ন সম্ভব ঢাকাবাসীর নিকট তারই নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হিসেবে এটাই তিনি কাজে প্রমাণ করে গেছেন।
১৯৯৬-এর মার্চের শেষ সপ্তাহে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফ তার নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে এবং যার ফলে ’৯৬-এর ১২জুন দেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে দেশ পরিচালনার জন্য মোহাম্মদ হানিফের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে পরিচালিত গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং সেসময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগষ্ঠ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাকমঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে তার প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্পিøন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসাতেও কোনো ফল হয়নি বরং মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় ও অস্ত্রোপ্রচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ।
জনগণের কল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। আর রাজনীতির উজ্জ্বল ধ্রুবতারা ছিলেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিতে এই অকুতোভয় সৈনিক রাজপথে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজধানীর প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৬-এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পূর্বে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্পিন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ২৮ নভেম্বর ’০৬ রাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ তার ষষ্ঠদশ মৃত্যুবার্ষিকী। মোহাম্মদ হানিফ চলে গেলেন জাতির এক চরম দুঃসময়ে। একজন সফল রাজনৈতিক এবং সকল গুণাবলীর অধিকারী মোহাম্মদ হানিফ তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। আমরা তার বিদেহি আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক : সাংগঠনিক সচিব
মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন

 

×