ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্ত কাপাসিয়া

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৩ নভেম্বর ২০২২

মুক্ত কাপাসিয়া

মুক্ত কাপাসিয়া

১৯৭১ সাল। রমজান মাস। এফ এফ বাহিনীর কমান্ডার মাহবুবুল আলম খান বেনু ভাই এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাপাসিয়া উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের ধানদিয়া গ্রামের বটতলায় রফিজউদ্দিন নায়েব ও আফতাব উদ্দিন নায়েবের বাড়িতে ক্যাম্প করে অবস্থান করছিল। এ ক্যাম্পের নেতৃত্বে আমি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সহকারী ছিলেন আব্দুল মান্নান মোল্লাহ। সম্ভবত ২১ নভেম্বর রোজার ঈদ ছিল। সে সময় পরিকল্পনা গ্রহণ করি যে, কাপাসিয়া পাকসেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে। এজন্য তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি।

আমাদের গ্রুপের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নাজিম উদ্দিন, বাড়ি রায়েদ ইউনিয়নের বাগেরহাট গ্রামে। তিনি অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধা। তাকে দিয়ে প্রথমে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু“করি। তিনি সাধারণ মানুষের বেশে কাপাসিয়া পাইলট স্কুল মাঠে অন্যান্য লোকের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। স্থানীয় রাজাকাররা তাকে চিনত না। এভাবে তিনি কয়েকদিন তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কাপাসিয়া পাইলট স্কুলে অবস্থানরত পাক সেনাদের অবস্থান কোথায়, কী আছে ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।
এ ব্যাপারে আমি নিজেও কাপাসিয়া আসি। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার কাপাসিয়ার হাটবার ছিল। বর্তমানেও তাই আছে। যদিও অন্যবারের সঙ্গে শনিবার আর মঙ্গলবারের পার্থক্য এখন খুব একটা বোঝা যায় না। আমি হাটবারের দিন সাফাইশ্রী খেয়া পার হয়ে সাফাইশ্রী মোড়ে বর্তমানে যেখানে বিএডিসির অফিস, সেখানে একজন অফিসারের নিকট আসতাম। অবশ্য তখনও এখানে বিএডিসির অফিস ছিল। একজন অফিসার ছিলেন, তার বাড়ি গফরগাঁও। তার মাধ্যমে আমি রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করতাম, যারা আমার বিশ্বস্ত ছিল এবং আমিও তাদের বিশ্বস্ত ছিলাম।
অধিকতর সঠিক ও আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য আমার এক বন্ধুর সহযোগিতা নেই। সে আমার সহপাঠী, কাপাসিয়া ইউনিয়নের জামিরারচর গ্রামের ফজলু রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল। তার কাপাসিয়া ক্যাম্পে ছিল নিয়মিত যাতায়াত। সে সুবাদে পাকসেনাদের ক্যাম্পের অনেক বিষয় তার জানা ছিল। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। যোগাযোগ সূত্রে ফজলু আমাকে পত্র দেয়। পত্রের মর্মানুযায়ী আমি দুজন সহযোদ্ধা রফিক ও কেসলুকে নিয়ে ফজলুর উদ্দেশ্যে জামিরারচর যাওয়ার জন্য ২২ নভেম্বর ধানদিয়া থেকে রওনা দেই। মুক্তিযোদ্ধা রফিকের বাড়ি চাঁদপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে। কেসলুর বাড়ি সনমানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামে।

রওনা দেওয়ার সময় আমরা ২টি এসএমজি, ২টি এন্টিট্যাংক মাইন সঙ্গে করে নেই। আমরা সকাল ১০টার দিকে ধানদিয়া বটতলা থেকে নৌকায় রানীগঞ্জ বাজারে যাই। রানীগঞ্জ বাজার থেকে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে বরুন, কান্দানিয়া রাউৎকোনা হয়ে সন্ধ্যার দিকে জামিরারচর গ্রামের শাহজাহান ভাইয়ের বাড়িতে যাই। তিনি তখন ছাত্রলীগের নেতা। তার সঙ্গে পূর্বেই আমি যোগাযোগ করেছিলাম। তার বাড়িতে আমরা রাতযাপন করি। সেখান থেকে শাহজাহানের মাধ্যমে রাজাকার ফজলুর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ফজলুর সঙ্গে সময় নির্ধারণ করা হয় ২৩ নভেম্বর বিকাল ৪/৫টার মধ্যে। শাহজাহানের বাড়ির পাশের টেকে সে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবে।

নির্ধারিত সময়ের একটু পূর্বে টেকের এমন জায়গায় অবস্থান নিয়েছিলাম যে, আমি যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে একটু সামনে বামে এবং ডানে ২টি ঝোপ। ঝোপের মধ্যে দুই মুক্তিযোদ্ধা আড়াআড়িভাবে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। ফজলু নির্ধারিত সময়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। আমার সামনের বামে এবং ডানে দুই ঝোপের মধ্যবর্তী স্থানে ফজলুকে বসালাম। যাতে ফজলু যদি বিরূপ কিছু করে তবে যেন ঝোপে অবস্থানরত দুই মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ করে তাকে পরাস্ত করতে পারে।
ফজলু এলো। আমার সঙ্গে কোলাকুলি করল। কিন্তু সে জানত না যে, ঝোপে দুই মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়ে আছেন। তাকে তার নির্ধারিত স্থানে বসতে বললাম। বসেই সে আমাকে একটি সিগারেট অফার করল। আমি তাকে বললাম, ‘তুই আগে সিগারেটটা জ্বালাইয়া টান দে, পরে আমাকে দে। আমি বেশি টানতে পারি না।’ যথারীতি সে সিগারেট জ্বালাল এবং ২/১ টান দিল। পরে তাকে আমি বললাম, ‘দে এখন তোর সিগারেটা দে, তুই আরেকটা জ্বালিয়ে নে’। সে আমাকে তার সিগারেটটা দিল। আমি টানতে থাকলাম। এখন কেউ হয়তো বলতে পারেন নতুন সিগারেটা না নিয়ে ফজলুর টানা সিগারেট কেন নিলাম। এর কারণ ছিল এই- ফজলু বন্ধু হলেও রাজাকার।

তাকে সর্বদা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা আমাদের নিয়ম। সে সিগারেটে কিছু মিশিয়ে রাখতে পারত, যা আমার জন্য মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই তাকে আগে সিগারেট জ্বালাতে বলেছিলাম। সে সিগারেট টান দেওয়ার পর যেহেতু তার কোনো সমস্যা হয়নি, সে জন্য তার নিজের সিগারেটটাই আমি নিয়েছিলাম। যা হোক, তার সঙ্গে কাপাসিয়ার পাক সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণের বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করি এবং তথ্য সংগ্রহ করি।
ফজলুর কাছ থেকে প্রয়োজনীয তথ্যাদি প্রাপ্তির পরে তাকে ছেড়ে দেই।

সে চলে যাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, কাপসিয়ার সকল মুক্তিযোদ্ধা চার ভাগ হয়ে পাক সেনাদের ক্যাম্পে চারদিক থেকে ২৩ নভেম্বর রাতে একই সময়ে আক্রমণ করবে। সেই অনুযায়ী রাতে আমি আমাদের নিজস্ব কুরিয়ারের মাধ্যমে বেনুদার নিকট আমাদের পরিকল্পনা পাঠিয়ে দেই। বেনুদা সেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাপাসিয়ায় অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশনা পাঠান। রাতে আমরা শাহজাহান ভাইয়ের বাড়িতে অবস্থান করি।
ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে সকালের কার্যক্রম সম্পন্ন করি। সকাল ৬টা কিংবা ৭টার দিকে লোক মারফত খবর পেলাম কাপাসিয়া ক্যাম্প থেকে পাক সেনা এবং তাদের দালাল এ কে শফি উদ্দিন আহমদ, আরিফ দরজি, আমির আলী মাস্টার জামিরারচর ব্রিজের নিকট অবস্থান করছে। এ খবরের সত্যতা যাচাই করি। এরপর তাদের আক্রমণ করা যায় কি-না সে ব্যাপারে এন্টিট্যাংক মাইন নিয়ে জামিরারচর ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বে কাপাসিয়া-রাজেন্দ্রপুর সড়কে পোঁতার পদক্ষেপ নেই। কিন্তু আমরা কেবল ৩ জন, তাছাড়া সড়কে ইট খুলে এন্টিট্যাংক মাইন পোঁতা দুরূহ ব্যাপার।

তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম এখনি আক্রমণ রচনা করা বোকামি হবে। তাই সড়ক থেকে ফিরে এসে লোকালয় দিয়ে জামিরারচর ব্রিজের পূর্বপাশে যেখানে রাজাকারদের একটি বাহিনী অবস্থান করছিল সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করি। রাজাকারদের ক্যাম্পের কাছাকাছি আসার পর লক্ষ্য করলাম উল্লিখিত দালালরা একটি গরুর গাড়িতে বসা। ওই গাড়িতে পাক সেনারা এলএমজি সামনের দিকে তাক করে এগিয়ে যাচ্ছে। আর পাক সেনারাও একই কায়দায় অস্ত্রশস্ত্রসহ জামিরারচর ব্রিজ দিয়ে রাজেন্দ্রপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

তারা যত অগ্রসর হচ্ছে আমি রাজাকার ক্যাম্পের দিকে তত অগ্রসর হচ্ছি। আমি তখন লক্ষ্য স্থির করলাম যেহেতু পাকসেনাদের আক্রমণ করতে পারলাম না, সেহেতু অন্তত রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করাব এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে নেব। তা বাস্তবায়নের জন্য আমি ২ মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার ক্যাম্পের পেছনে লুকিয়ে থাকতে বললাম। আর আমি অস্ত্রবিহীন অবস্থায় রাজাকারের থাকার ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই বললাম, ‘চারদিকে মুক্তিবাহিনী তোমাদের ঘেরাও করে আছে। পাক সেনারা চলে গেছে। তোমাদের আর রক্ষা করার কেউ নেই। বাঁচতে চাইলে সব অস্ত্র একসঙ্গে আঁটি বাঁধ আর আমার সঙ্গে চল। তারা তখন পান্তাভাতের নাস্তা করছিল।

তারা নাস্তা শেষ করতে চেয়েছিল। আমি তাৎক্ষণিক কঠোরভাবে না করে বললাম, তাহলে এখনই গুলি চালাব। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা ভয় পেয়ে অস্ত্রগুলোর দুটি আঁটি বাঁধল। গুলির বাক্সগুলোও একত্রিত করল। অস্ত্রের আঁটি ও গুলির বাক্স রাজাকারদের মাথায় তুলে দিলাম এবং তাদের কাপাসিয়ার দিকে অগ্রসর হতে বললাম। তারা নির্দেশমতো এগিয়ে চলল। এরই মধ্যে আমি রফিক এবং কেসলুকে আমার কাছে আসতে বললাম।

তারা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাথায় অস্ত্রের আঁটি উঠিয়ে দেই এবং গোলাবারুদ রাজাকাররা বহন করছিল। রাজাকাররা অনেকেই আমার পরিচিত ছিল। আমি তাদের জয় বাংলা স্লোগান দেওয়ালাম। স্লোগান দিতে দিতে আমরা কাপাসিয়া পাইলট স্কুলে যেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল সেখানে ঢুকলাম। তল্লাশি করে দেখলাম সবকিছু নিয়েই তারা পালিয়েছে।
আমি তখন রাজাকারদের নিয়ে স্কুলের নদীর পাড় আমগাছের তলায় যাই এবং জয় বাংলা স্লোগান দিতে থাকি। নদীর ওপারের চরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিল। তারা জয় বাংলা স্লোগান শুনে কিছুই বুঝতে পারছিল না। বরং অনেকটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। তখন আমগাছ তলার পিলারে ওপরে উঠে বলি, আমি শহীদুল্লাহ। কাপাসিয়ায় হানাদারমুক্ত। আমিই জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা সবাই কাপাসিয়া চলে আসুন। আমার কণ্ঠ শুনে ওপারের চরের মুক্তিযোদ্ধারা আশ্বস্ত হলো এই ভেবে যে, এটা শত্রুদের প্রতারণা নয়।

মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে ধীরে তাদের বহু আকাক্সিক্ষত কাপাসিয়ার দিকে আনন্দচিত্তে বিজয়ীর বেশে আসছে। আমি আমার সঙ্গে তাদের নিয়ে কাপাসিয়া থানা বা পুলিশ স্টেশনের দিকে যাই। লক্ষ্য- থানার অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখলে আনা এবং পুলিশদের আমাদের অধীনস্থ করা। আমরা যখন থানার সামনে গেলাম এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেনুদা এবং তরগাঁওয়ের মান্নান মুক্তিযোদ্ধাসহ এখানে চলে আসেন। আমরা তখন সবাই আনন্দে আত্মহারা। তখন সকল মুক্তিযোদ্ধা মিলে যার যার অস্ত্র ওপরে তুলে কাপাসিয়া বাজার এলাকা জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত করলাম।

কাপাসিয়া হানাদারমুক্ত। মানুষের মনের ভেতরের ভীতি কমে এলো। সেই এপ্রিলে ছেড়েছি কাপাসিয়া। দীর্ঘ ৮ মাস লড়াই সংগ্রাম আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে আবার বিজয়ী বীরের বেশে ফিরে এলাম আমাদের প্রিয় কাপাসিয়ায়, যে কাপাসিয়ায় আর কোনো আক্রমণ হবে না। বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেওয়া হবে না। সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ এগুলো থাকবে না। সকলে হানাদারমুক্ত কাপাসিয়ায় সুখে-শান্তিতে নিরাপদে থাকবে। কাপাসিয়ার মানুষ আবার বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। এগিয়ে যাবে স্বপ্নপূরণের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা
সাবেক সংসদ সদস্য

×