ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নোবেলের দেশ থেকে

পিতার পথ ধরে পুত্র জিতে নিলেন মেডিসিনের নোবেল

দেরওয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২১:৫০, ৬ অক্টোবর ২০২২

পিতার পথ ধরে পুত্র জিতে নিলেন মেডিসিনের নোবেল

পিতার পথ ধরে পুত্র জিতে নিলেন মেডিসিনের নোবেল

চিকিৎসা শাস্ত্রে ২০২২ সালের নোবেল পুরস্কার জিতলেন ৬৭ বছর বয়স্ক সুইডিশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক সভান্তে প্যাবো (Svante Pääbo)। একই শাখায় তার বাবা খ্যাতিমান বিজ্ঞানী- বায়োকেমিস্ট অধ্যাপক সুনে বারিস্ট্রোম (Sune Bergström) পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮২ সালে। তিনি মারা যান ২০০৪ সালে। সভান্তে প্যাবো জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালের ২০ এপ্রিল সুইডেনের স্টকহোমে। 

আদিম মানুষের জিনোম উদ্ঘাটন ও মানব বিবর্তনের জিনোম সম্পর্কিত অস্তিত্ব আবিষ্কারের জন্য তাকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। বিলুপ্ত মানুষ ও চলমান আধুনিক প্রজন্মের মানুষের জিনের মধ্যে যোগসূত্র প্রকাশ করার জন্য একটি সম্পূর্ণ নিয়ান্ডারথাল জিনোম সিকোয়েন্সের রহস্যকে তিনি তার  গবেষণার মধ্য দিয়ে উন্মোচন করে নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন।
বিজ্ঞানের নানান শাখায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারীদের জন্যই আলফ্রেড বার্হার্ড নোবেলের উইল অনুযায়ী প্রবর্তন করা হয়েছে নোবেল পুরস্কার। বিলুপ্ত হোমিনিনের জিন ও মানব বিবর্তনের নতুন তত্ত্বই ছিল এই গবেষণার মূল তত্ত্ব। যুগান্তকারী এই তত্ত্বের নতুন দুয়ার তিনি উন্মোচন করেছেন একাই। তার বাবা খ্যাতিমান গবেষক, বিজ্ঞানী সুনে বারিস্ট্রোম বেঙ্গট স্যামুয়েলসন ১৯৮২ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন যৌথভাবে জন আর ভ্যানেদর সঙ্গে।

সেদিক থেকে বাবার প্রতিভাকেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। মানব অস্তিত্ব, তার রূপান্তর ও বিবর্তনের মতো জটিল ও দুরূহ একটি গবেষণায় নিজেকে লিপ্ত করে নিরলস সাধনা দিয়ে যে অশ্রুতপূর্ব ও অভিনব তত্ত্ব সূত্রের ভা-ার তিনি উপস্থাপন করেছেন তার সেই অসাধারণ কৃতিত্বের জুড়ি তিনি নিজেই। প্যাবো তার এই গবেষণার মাধ্যমে আগের অজানা একটি মানব প্রজাতির অস্তিত্বের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সামনে এনেছেন, যা ডেনিসোভান নামে পরিচিত। যারা মানব বিবর্তন নিয়ে পড়াশোনা করছেন তাদের কাছে নামটি অপরিচিত নয়।
নোবেল কমিটি বলেছে, তিনি আমাদের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়ান্ডারথালের জেনেটিক কোড ক্র্যাক করার মতো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটি করতে পেরেছেন। বর্তমান  আধুনিক প্রজন্মের মানুষের আরেক জ্ঞাতিভাই ডেনিসোভানদের আবিষ্কার করার ক্ষেত্রেও ‘চাঞ্চল্যকর’ কাজের নজির স্থাপন করেছেন তিনি।
আমাদের শিকড়ের সন্ধান– আমরা কোথায় ছিলাম, কেমন ছিলাম, আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমাদের জ্ঞাতি কারা, সেই জ্ঞাতিরা কিভাবে এবং কেন  বিলুপ্ত হলো, কেন হোমো স্যাপিয়েন্সের অস্তিত্ব রয়ে গেল, আমরা কিভাবে কথা শিখলাম, কেন আমরা কথা বলতে পারি, আমাদের জ্ঞাতিরা কি আমাদের মতো  কথা বলতে পারত- এই প্রশ্নগুলো নিয়ে যেসব আণবিক জীববিজ্ঞানী, মানুষ জাতি জিনবিজ্ঞানী, বিবর্তনীয় জিন বিজ্ঞানীরা যে নিরলস কাজ করছেন তাদের মধ্যে প্যাবো  নিজের বিরল উদ্ভাবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি একজন প্যালিওজেনোমিক্স বা প্রতœজিনবিদ্যার অন্যতম স্থপতি।
জীবিত মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করার বিষয়টি এখন নতুন কোন বিষয় নয়। তবে সহস্র বছরের প্রাচীন মমি বা প্রাচীন  কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আমাদের ইতিহাস, আমাদের পূর্ব পুরুষ, বংশধর, অস্তিত্বহীন বিলুপ্ত জ্ঞাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য প্রাপ্তির অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞান হাজির করার এই কৃতিত্ব যেন সৃষ্টির রহস্যে নতুন বিস্ময় জাগিয়ে তুলছে।

পৃথিবীর সকল কোণে  প্রাচীন জাতি, জ্ঞাতি, জনগোষ্ঠী, জনপদ বা  বিলুপ্ত বংশীয় ধারার অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া এখন আর অকল্পনীয় বিষয় নয়। প্রত্ন বিজ্ঞানের ধারায় এই গবেষণা যুক্ত হয়ে এক মিরাকল সাধন করে বসেছে। ভারতের ইতিহাস সন্ধান প্রশ্নে ২০১৯ সালে প্রকাশিত জিন বিদ্যার বিভিন্ন গবেষণাপত্র রাজনৈতিক মহলে যে ঝড় তুলেছিল সেখানে ডেভিড রাইখের নামটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। প্যাবোর উচ্চমানের গবেষণা তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আমাদের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়ান্ডারথালের প্রাচীন কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে সফল হয়েছেন।
 প্যাবো ২৪০০ বছর আগের মমির ডিএনএ বিশ্লেষণ করতেও সক্ষম হয়েছেন। সেখানে দেখা গেছে,  হরিয়ানার রাখিগর্হিতে ৪৫০০ বছর আগের হরপ্পীয় সভ্যতার ৬১টি কঙ্কালের মধ্যে মাত্র ১টির সফল ডিএনএ সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয়েছিল দক্ষিণ কোরীয় জিন বিজ্ঞানীদের দ্বারা। সেখানে ৩৫-৪০ হাজার বছর আগের ‘অন্য মানুষে’র কঙ্কালের জিনোম সিকোয়েন্স করার চেষ্টা করেছিলেন তারা।  সফল হননি। প্যাবো চেষ্টা করেছেন  বিলুপ্ত বিভিন্ন মানব প্রজাতির প্রাচীন ডিএনএ থেকে পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্স করে তাদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের জিনের তুলনা করতে। সফলকাম হয়েছেন তিনি।
জানা যায়, আধুনিক মানুষ ও ‘নিয়ান্ডারথাল’রা নিজেদের মধ্যে মিলনে সক্ষম ছিল। শুধু তাই নয়, তাদের সন্তানরাও পরের প্রজন্মের জন্ম দিতে পেরেছে। আজও তাই আফ্রিকার বাইরে সব মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে ১-৪% ‘নিয়ান্ডারথাল’ জিন। তথ্য সূত্র বলছে,  আমাদের বিলুপ্ত আত্মীয়দের কাছ থেকে পাওয়া কিছু জিন আজকের মানুষের শরীরবিদ্যাকে প্রভাবিত করে। এরকম একটি জিন হলো  জিনের ডেনিসোভান সংস্করণ, যা উঁচু জায়গায় কার্যকরভাবে জীবন্ত থাকে। এখন তিব্বতীদের মধ্যে এই জিন পাওয়া যায়। নিয়ে-ারথালের জিনও বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
বিজ্ঞানীদের নিরলস অধ্যবসায় ও সাধনার ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে নতুন নতুন অভিনব মাত্রা যোগ হচ্ছে তাতে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি বিলুপ্ত মানুষ প্রজাতির জিনের সঙ্গে বর্তমান আধুনিক প্রজন্মের মানুষের জিনের তুলনামূলক কার্যকারিতা ইপ্সিত উদ্দেশ্য পূরণে কাক্সিক্ষত সমাধান বয়ে আনবে। জিনবিদ্যা গবেষণায় এই দিগন্ত উন্মোচন  গবেষণায় উৎসাহী  প্রজন্মকে এক নতুন পথে টেনে নিয়ে যাবে।

তারা প্রত্নজিনবিদ্যা, জিনজাতি জিনবিদ্যা, বিবর্তনীয় জিনবিদ্যার বিষয়কে নতুনভাবে নিজেদের চিনতে, জানতে, প্রাগৈতিহাসিক সময়কালের প্রত্নজিনকে তুলে ধরতে এগিয়ে আসবে নিজেদেরই প্রয়োজনে। প্যাবো তেমন একটি রাস্তা দেখিয়ে গেলেন। নিজে মাটি খুঁড়ে তৈরি করে দিলেন একটি নতুন পথ।
প্যাবোর মা কারিন প্যাবো ছিলেন একজন রসায়নবিদ। সুইডেনে এসেছিলেন রিফিউজি হিসেবে। প্যাবোর বাবার সঙ্গে তার সংসার হয়নি। প্যাবো থাকতেন মায়ের সঙ্গে স্টকহোমের বাগারমুসেন এলাকায়। তবে বাবা প্যাবোর সঙ্গে গোপনে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।
বিজ্ঞানী প্যাবো ১৯৭৫ সালে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ফ্যাকাল্টিতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ইতিহাস, মিসরীয় ইতিহাসতত্ত্ব ইজিপ্টোলজি এবং রাশিয়ান ভাষা ও ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৭৫-৭৬ সালে তিনি নিয়ম অনুযায়ী বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি উপসালায় মেডিসিনে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৮১ সালে তিনি ডক্টরাল গবেষণার পাশাপাশি সেল গবেষণায় মগ্ন হয়ে পড়েন। ১৯৮৫ সালে তিনি ২৪০০ বছরের পুরনো মমি থেকে ডিএনএ আলাদা করার কৃতিত্ব দেখিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান গবেষকদের জগতে আলোড়ন তোলেন।

১৯৮৬ সালে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি জার্মানির জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলেতে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। এরপর সেখানে তিনি  বায়োকেমিস্ট এল্যান উইলসনে  গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দেন। উইলসন ১৯৯১ সালে মারা যাবার পর প্যাবো ফিরে আসেন জার্মানিতে। তিনি ১৯৯০ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন অধ্যাপক হিসেবে। তারপর থেকে তিনি স্থাপন করে যাচ্ছেন কৃতিত্বের মাইলফলক।
প্যাবো ১৯৯৯ সালে ’বিবর্তনীয় নৃবিজ্ঞান’-এর জন্য জার্মানির লিপজিগে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি বর্তমানে কর্মরত। এর পাশাপাশি ২০২০ সাল থেকে তিনি জাপানের ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজিতে একজন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবেও নিযুক্ত রয়েছেন। প্যাবো ২০০৮ সালে বিয়ে করেন মার্কিন জেনেটিক গবেষক লিন্ডা ভিজিলান্টকে। তাদের রয়েছে দুটি সন্তান। স্ত্রী নিজেও লিপজিগে  ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটে এভ্যুলুশনারি এন্থ্রপোলজি বিষয়ে কর্মরত।
গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে তাপমাত্রা ও স্পর্শের রিসেপ্টর আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড জুলিয়াস ও আর্ডেম প্যাটাপৌসিয়ান। ১৯০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মেডিসিনে পুরস্কার জিতেছেন ১১৩ জন। সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ৩২ বছর বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেন কানাডার নাগরিক ফ্রেডারিক বান্টিং।

জন্মেছিলেন কানাডার অন্টারিওতে একটি ফার্ম হাউসে বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে। তিনি ডায়াবেটিক রোগীর ইনসুলিন আবিষ্কার করে মানবকল্যাণে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। তিনি একাধারে ছিলেন  চিকিৎসক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও পেইন্টার। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে তার সহযোগী ছিলেন ব্রিটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী জন জেমস রিকার্ড। তারা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার  লাভ করেন।
চলতি বছর পর্যন্ত মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ৮ জন সুইডিশ। তারা হলেন  অলভার গুল স্ট্রান্ড (১৯১১), হুগো থিওরেল (১৯৫৪), রাংনার গ্রানিট (১৯৬৭ যৌথভাবে),   উলফ ভন ইউলার (যৌথভাবে ১৯৭০), টরস্টেন বাইসেল (যৌথভাবে ১৯৮১), সুনে বারিস্ট্রোম বেঙ্গট স্যামুয়েলসন (যৌথভাবে ১৯৮২), সভান্তে প্যাবো (২০২২)। সর্বমোট নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সুইডিশের সংখ্যা হলো ৩৩ জন। তাদের মধ্যে রসায়নে ৫ জন, পদার্থ বিজ্ঞানে ৫ জন, মেডিসিনে ৮ জন, সাহিত্যে ৮ জন, শান্তিতে ৫ জন এবং অর্থনীতিতে ২ জন।
১৯০১ থেকে ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে মোট ৬১০ বার। অর্থনীতিসহ ৬টি শাখায় বিজয়ীর সংখ্যা ৯৭৮ জন। নারী বিজয়ী ৫৯ জন, প্রতিষ্ঠান ২৫টি। সর্বকনিষ্ঠ বিজয়ী ছিলেন শান্তিতে মালালা ইউসুফ জাই ২০১৪ সালে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ জন বি গুড এনাফ  ৯৭ বছর বয়সে ২০১৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান।
মহাত্মা গান্ধীকে কেন দেয়া হয়নি
নোবেল শান্তি পুরস্কার
(গত শুক্রবারের পর)
তৃতীয়বারের মতো তার নাম এসেছিল শর্ট লিস্টে। এবার প্রার্থী ছিলেন মাত্র তিনজন। নোবেল কমিটির উপদেষ্টা সেইপ তার প্রতিবেদনে গান্ধীর জীবদ্দশার শেষ পাঁচ মাসের কর্মকা-ের মূল্যায়নে বলেন, গান্ধী তার দীর্ঘ জীবন সংগ্রামে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনে নৈতিকতার এক গভীর ছাপ রেখে গেছেন, যা ভারত এবং ভারতের বাইরের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে আদর্শ হিসেবে বিদ্যমান থাকবে। গান্ধীর এই আদর্শ ও মনোভাবকে কেবল একজন ধর্ম প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে।
নোবেল কমিটির ভেতর গান্ধীকে মরণোত্তর পুরস্কার প্রদান নিয়ে অনেকেই জোরালো দাবি তুলেছিলেন। তাদের দাবি ছিল-  বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এটা করা যেতে পারে। কিন্তু শেষমেশ তাদের সেই দাবি ও যুক্তি ধোপে টেকেনি। নোবেল ফাউন্ডেশনের লিখিত বিধান অনুযায়ী এভাবে পুরস্কার প্রদানের সুযোগ নেই। অথচ তার আগে নিয়ম ভঙ্গ করে দুজন সুইডিশকে মরণোত্তর পুরস্কার দেয়া হয়েছে সাহিত্য এবং শান্তিতে।

গান্ধীকে মরণোত্তর পুরস্কার না দেয়ার আরও যুক্তি ছিল-  গান্ধীর কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান এবং সম্পদ ছিল না। তার কোন লিখিত উইলও ছিল না। কে তার এই পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করবে? নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক অগাস্ট শোউ, কমিটির উপদেষ্টা, আইনজীবী উলে টরলেইফ রোডকে বলেন, এমন একটি কাজ করার আগে আমাদের তার পরিণাম চিন্তা করতে হবে। এ ব্যাপারে সুইডিশ নোবেল কমিটিগুলোর কাছে পরামর্শ চাওয়া হলে তারা নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে।

সিদ্ধান্তহীনতার এই সঙ্কটে পড়ে শেষমেশ নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ১৯৪৮ সালের ১৮ নবেম্বর ঐ বছর উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ায় শান্তি পুরস্কার প্রদান স্থগিত করার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে। এ বিষয়ে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান গুনার ইয়াহান তার ডায়েরিতে লিখেছেন-  এত মতদ্বৈততার পরেও কমিটির একজন সদস্য মিঃ অফটেডাল গান্ধীকে মরণোত্তর পুরস্কার দেয়ার পক্ষেই ছিলেন। তবে এ বিষয়ে একটি ধোঁয়াশাও রয়ে গেছে। মরণোত্তর পুরস্কারের জন্য আরেকজন প্রার্থী ছিলেন সুইডেনের।

তিনি ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত সুইডেনের দূত কাউন্ট বারনাদোত। তিনিও ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুন হন প্যালেস্টাইনে। তিনি মনোনয়ন তালিকায় ছিলেন না। তবে কথা উঠেছিল তাকে নিয়েও। নোবেল সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেই বলেছেন- গান্ধী আর একটি বছর বেঁচে থাকলে তার হাতছাড়া হতো না এই পুরস্কার।
জার্মানির নাৎসী নেতা এডলফ হিটলারের ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনে মানুষ যখন অতিষ্ঠ এবং সুইডেনের রাজনীতিতে হিটলার প্রসঙ্গে আলোচনা তুঙ্গে, তখন ১৯৩৯ সালের ২৪ জানুয়ারি তার প্রতি বিদ্রƒপাত্মক সম্মান জানাবার প্রহসন করার জন্য নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটির কাছে সুইডিশ পার্লামেন্টারিয়ান ই জি সি ব্রান্ডট ১২ জন পার্লামেন্ট সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে শান্তি পুরস্কারের জন্য হিটলারের মনোনয়নপত্র পাঠান।
ঐ ১২ জন পার্লামেন্ট সদস্যই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইনের শান্তি পুরস্কারের মনোনয়নে সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। তবে হিটলারের মনোনয়নপত্রটি খুব দ্রুতই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। চেম্বারলেইন ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হিটলারের সঙ্গে দমিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষর করে বিশ্বশান্তি রক্ষা করেছিলেন বলে চেম্বারলেইনের পক্ষে এই ১২ জন সমর্থন ব্যক্ত করেন।     (সমাপ্ত)

লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক
স্টকহোম, ৫ অক্টোবর, ২০২২
[email protected]

×