ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শরতের উৎসব

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ৪ অক্টোবর ২০২২

শরতের উৎসব

সনাতন ধর্ম মানুষের লৌকিক জীবনকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছে

দেবী দুর্গা ও তার সন্তানদের যে রূপ তা আর্যের। কোল ভিল সাঁওতালদের দেশে আর্য মায়ের এত প্রভাব কি করে হলো সে এক রহস্য। বাংলা অঞ্চল ছাড়া দুর্গা অন্য কোথাও এত আড়ম্বরে পূজিত হন না। ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে মূল উৎসব দুর্গাপূজা নয় দেয়ালি বা দীপাবলি, কোন কোন রাষ্ট্রে দুর্গার সন্তানরা আলাদাভাবে মর্যাদা পান। মহারাষ্ট্রে গণেশ সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। লক্ষ্মী সরস্বতীর ভক্তও প্রচুর।

মগধ উৎকল আর উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা গৌড় রাজ্যের পরাক্রমশালী রাজা শশাঙ্ক ছিলেন লক্ষ্মীর ভক্ত। অবশ্য তার মূল উপাস্য ছিলেন শিব। দুর্গার স্বামী। তার আমলে চালু মুদ্রার এক পিঠে ছিল শিবের মূর্তি অন্য পিঠে লক্ষ্মীর। সেও সেই ছ’শ’ খ্রিস্টাব্দের কথা। অত আগে থেকে দুর্গা পরিবারের সদস্যদের পূজা হয়ে এলেও একমাত্র বাঙালীর কল্পনায়ই তিনি পুত্র-কন্যা সিংহ বাহিনীসহ পূর্ণরূপে ধরা দিয়েছেন।

আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে আসেন তিনি। তখন শরতকাল। শরতের আকাশ মোটেই ‘মন কেমন করা’ নয় বরং উজ্জ্বল নীলাকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ ঠিকরানো আলো মনকে নাচিয়ে দেয়। কৈশোরের নির্ভার আনন্দে ভেসে যাওয়া যেন- ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে...।’ এই আকাশ এই প্রকৃতি দেখতে পান যারা, যারা শুনতে পান এই সুর’ শারদ উৎসব তাদের। ধর্মের গ-ি ছাপিয়ে সেখানে উপচে পড়ে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। ছন্নছাড়া স্বামী শিব, তিনি শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ান।

সারাবছর তাকে আগলে শরতে হিমালয়ের কৈলাস থেকে নেমে আসেন উমা। এই শ্যামল প্রকৃতির বাংলা তার বাপের বাড়ি। সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন তিনি। ঢাক-শঙ্খ ধান-দূর্বায় উৎসবে মাতান বাপের বাড়ির সবাইকে। শারদ উৎসবের লৌকিক দিক বড় বেশি জীবন ঘেঁষা। চেনা জীবনের গল্পই বলে সে। আর অতি লৌকিক দিক সমৃদ্ধ করেছে পুরাণ সাহিত্য।
সেই প্রাচীন যুগে পৌরাণিক সাহিত্যের এত সমৃদ্ধি কি করে হয়েছিল, সেও এক বিস্ময়। পৃথিবীর পুরাণ সাহিত্যে ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে গ্রীক পুরাণের। বিস্তৃৃতি ও ব্যাপকতায় তা গ্রীক পুরাণকে ছাপিয়ে গেছে। এক ক্ল্যাসিক পুরাণ থেকে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য অনু পুরাণ। তাকে আশ্রয় করে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য। মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, অন্নদামঙ্গল, মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যানের স্বাদ যারা নিয়েছেন, তাদের মন থেকে তা কি কখনও মোছা সম্ভব?
এসব কাহিনীর লৌকিক-পারলৌকিক দু’রকম পাঠই আছে। পারলৌকিক পাঠ বেঁচে আছে ধর্মবিশ্বাসে আর লৌকিক পাঠ সাহিত্যের সম্পদ। গ্রীক পুরাণ থেকে ভারতীয় পুরাণ সম্ভবত এখানেই আলাদা। গ্রীক পুরাণের চরিত্ররা সাহিত্যেই বিচরণ করেন। ভারতীয় পুরাণ চরিত্ররা জীবিত সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে।
শারদীয় দুর্গাপূজার আচার-অনুষ্ঠানের ভিত্তি ক্ল্যাসিক পুরাণ। দেবতাদের বিচরণ এলাকা স্বর্গরাজ্যে এক সময় হানা দেয় অশুভ শক্তি অসুর। তার তা-বে দেবতারা পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। অনেকে তাকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। অসুর দম্ভ করে বলে ‘কোনও পুরুষ আমাকে হত্যা করতে পারবে না’। এক সময় তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে এ বর দিয়েছিলেন। বর পেয়ে ধীরে ধীরে অসুরের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। ব্রহ্মা বিব্রত হন। নিজের দেয়া বর ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।

অন্য দেবতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি ঠিক করলেন নারী শক্তি দিয়ে অসুর দমন করবেন। যেহেতু তিনি নিজেই বলেছিলেন, অসুরকে কোনও পুরুষ হত্যা করতে পারবে না তাই নারীরূপে দুর্গার আগমন। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে আসেন, শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে তিনি এ পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলে।

শারদীয় পূজার প্রচলন রামচন্দ্রের সময় থেকে। রাবণের কাছে বন্দী সীতাকে উদ্ধার করতে যাওয়ার আগে রাম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তখন ছিল শরতকাল। শরত থেকে শারদীয়। ধর্মীয় ব্যাখ্যা যা-ই থাক কোথায় যেন এ উৎসব ধর্মকে ছাপিয়ে যায়। যেন প্রকৃতির উৎসব, ঋতু মেনে তিথি গুনে আয়োজন। কৃষিনির্ভর বাংলার দিনপঞ্জি চলত গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাবে। কৃষকের আনন্দ-বেদনার কাব্য রচিত হয় ঋতুকে কেন্দ্র করে। বারো মাসে তেরো পার্বণের যে প্রবাদ তারও ভিত্তি ওই ঋতু। ফসল বোনার, ফসল কাটার নবান্নসংক্রান্তি পিঠা-পায়েস ইত্যাদি নানা উপলক্ষে উৎসবের ছলে এক হওয়া, সে উৎসব বাঙালীর। ধর্মের আবরণটুকু সরিয়ে দিলে ভীষণই প্রাকৃতিক। ভীষণ নিজের। শাব্দিক অর্থেই সর্বজনীন। বাঙালীয়ানার সবটুকু ধারণ করে আছে এ উৎসব।
সনাতন ধর্ম মানুষের লৌকিক জীবনকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে এগোতে এগোতে অনেকটাই আত্মস্থ করেছে। তবে ধর্মীয় নিয়মনিষ্ঠার কড়াকড়ি একে সঙ্কীর্ণও করেছে। গোঁড়ামি সব ধর্মকেই সঙ্কীর্ণ করে; যার অনিবার্য পরিণতি হিংসা আর সন্ত্রাস। তার ওপর রয়েছে রাজনৈতিক ব্যবহার। ধর্মকে যখন থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়েছে, তখন থেকে এতে গোঁড়ামি ও সন্ত্রাস ঢুকেছে। মনকে মুক্ত রাখা তাই জরুরী। শিক্ষাদীক্ষা, রুচি মানুষকে মানুষের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

শুধু ধর্মের পরিচয়ে মানুষকে চিহ্নিত করা সঙ্কীর্ণতার প্রকাশ। মানুষের পরিচয় তার কাজে, আচরণে। দুটো ভাগ থাকতে পারে সেখানে। ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ। ভাল মানুষ তিনি যে ধর্মেরই হোন, ভালই। খারাপও তেমনি। যে ধর্মের হোক, খারাপই। ধর্ম বিশ্বাসের পূর্ব নির্ধারিত ধারণা মানুষ বিচারের মানদণ্ড হতে পারে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিন্যাসে এ বিষয়টি যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন পারিবারিক পরিম-লেও। স্কুলিং শুরুর সময় শিশু জানে না সে কোন্ ধর্মের। বেড়ে উঠতে উঠতে সহপাঠী ও শিক্ষকদের আচরণ তাকে জানায় ধর্ম পার্থক্যের বিষয়টি।

সে যে মূলধারার ধর্মের বাইরে উঠতে-বসতে সে কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়। পরিবারের শক্ত সাপোর্ট না থাকলে ওই শিশুর পক্ষে হীনম্মন্যতা অতিক্রম করা কঠিন। জীবনের শুরুতে হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়ে অনেকটা কৌশলী ও অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে সে; যা সুস্থ মানসিক বিকাশকে বাধা দেয়। যারা তাকে টিজ করে সে শিশুদের বিকাশই কি স্বাভাবিক হয়? তারাও এক ধরনের সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স নিয়ে বড় হয়; যা খণ্ডিত করে তাদের ব্যক্তিত্ব। পারস্পরিক এ বিদ্বেষ কাউকেই ধর্মের বাইরে ‘মানুষ’ ভাবতে শেখায় না। বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া দরকার। জীবন থেকে এ অস্বস্তিকর উপাদানগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারলে উৎসব হবে আরও আনন্দময়।

[email protected]

×