ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষুধামুক্ত হোক বিশ্ব

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ২ অক্টোবর ২০২২

ক্ষুধামুক্ত হোক বিশ্ব

.

সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা আসলে মাতৃশক্তির পূজা। মহাভাবের পূজা। এ ভাবটি নিরাকার, আবার সাকার। তাই এর মর্মার্থ গোপনে দেহাভ্যন্তরে পূজা অর্থাৎ, মানস পূজা। এটিই শ্রেষ্ঠ পূজাবিধি। দেহের ভেতরই সকল পূজার উপাচার। দেহ কিন্তু ক্ষুদ্র কিছু নয়। সাত্তের মধ্যে অনন্তের অনির্বাচনীয় আভাস। মানুষের দেহভা-ই ব্রহ্মা-। এ ভান্ডেই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম-গন্ধতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, আকাশতত্ত্ব- সবই। দেহের মধ্যেই দশ ইন্দ্রিয়ের বাস। মায়া, অমায়া, বৈরাগ্য, সংসার দেহকে ঘিরেই। সুতরাং দেহ ইন্দ্রিয়ই দেবী দুর্গা মায়ের পূজার উত্তম মন্দির। তাই ‘হে মন, তুমি মনোময় প্রতিমা গড়ে বসাও হৃদি পদ্মাসনে’।
দেবী দুর্গামায়ের পূজা নানা উপাচারে নিষ্পন্ন হয়। যেমন- গন্ধ পুষ্প, ধূপ দীপ নৈবদ্য ইত্যাদি। এ সব তো বাহ্য উপাচার। হৃদয়ের উপাচার দেয়া না হলে মায়ের পূজা হয় না। মায়ের পূজায় চাই ভাবের উপাচার- ভক্তি, বিশ্বস ও জ্ঞান। ভক্তি বিলাসে যেন গঙ্গাজল, মনো বিল্বদল-শতদল দিয়ে হয় সাধনা। ব্যক্তি স্বার্থ আশা বলি দিয়ে, বিলাস বাসনা ত্যাগ করে, জ্ঞান প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করলেই হবে সার্থক মাতৃপূজা। মাতৃপূজায় ভক্তির ভাবে জাতিভেদ হয় বিসর্জিত।

সাধনার পথে সাধক হবে নিঃসংশয়, সন্দেহমুক্ত ও নির্মল। শুদ্ধ ভক্তির গুণে ভক্ত পূজারীর মনে জেগে উঠবে মহাশক্তি। প্রকৃত অর্থে মহাশক্তির উদ্বোধনই মাতৃপূজার প্রধান লক্ষ্য। ভক্তিভাবে ডাকতে পারলে মা দুর্গাদেবী কী ভুলে থাকতে পারে? পারে না। শক্তির জাগরণ ঘটে ভক্তের হৃদয়ে- এটাই মাতৃপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শক্তি হচ্ছে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মের উপলব্ধি। সাকার থেকে নিরাকার। রূপময়ী মায়ের অণুধ্যান থেকে রূপহীন ব্রহ্মময়ী মায়ের ধারণা মাতৃপূজার তাৎপর্য। সাধকের মনে কোন উন্মোচন হয় ভক্তিভাবে মাতৃদেবীর পূজাচারে। জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হলে সাধক দেখেন সব একাকার।

জ্ঞেয়, জ্ঞাতা আর আলাদা থাকে না। মানস পূজা ও যোগ সাধনায় উপাস্য ও উপাসক সব এক হয়ে যায়। পূজা ও পূজারী, জীবাত্মা ও পরমাত্মা সবই একাকার। আর যিনি ব্রহ্মময়ী দেখেন তার ভাব আরও উচ্চস্তরের। তার কাছে বাহ্য ও মানস পূজা, আরাধনা অর্থহীন। যিনি একাকারভাবে ভাবিত একাত্ম অবস্থায় কে কার পূজা করবে? দুই না হলে সেবা ও সেবকের ভাব জাগ্রত হয় না। শক্তি পূজায় সাধকের উপলব্ধি সবই মা, সবই ব্রহ্মময়ী। এ যেন এক অচিন্ত্য তত্ত্ব। যার এ তত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তার আর কৃত্যাকৃত্য থাকে না। ‘দেহ-দেহী সবই তুমি’ এ ভাবেই সাধক সব কিছুতেই মাতৃময় উপলব্ধি করেন। এটাই দিব্যজ্ঞান শক্তি। মহাশক্তি দেবী আশ্রিতা হন সাধকের হৃদয় মন্দিরে। সুতরাং সাধক প্রার্থনা করে হে দেবী তুমি বিশ্বকে ক্ষুধা মুক্ত কর। তোমার সৃষ্ট জগতে সেরাসৃষ্টি মানব জাতি যেন ক্ষুধায় কষ্ট না করে। তোমার প্রার্থনায় মতি থেকে যেন ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে পারে হৃদয়ের মহান মঠে। এ তো গেল আধ্যাত্মিক পর্যায়।
ফিরে আসছি সমাজ জীবনের প্রহেলিকায়। যুগ যুগ ধরে দেবী দুর্গাপূজা হয়ে আসছে এ বিশ্বলয়ে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে পূজার দৃষ্টিভঙ্গি গেছে পাল্টে। এখন যেন সবাই ভক্তিভাবের বিপরীতে হৈ-হুল্লোর তামসিক ভাবের পূজায় নিবিষ্ট থেকে কেবলই মোটা অংকের অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় উঠেছে মেতে। দেবীর কাছে কী সেই প্রার্থনা পৌঁছায়? যদি পৌঁছাত তবে ক্ষুধায় মানুষের মৃত্যু ঘটত না। শিশু যখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে- মা দৌড়ে ছুটে যান দুগ্ধ পান করাতে।

শিশুর এই কান্না মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা। শিশু কাঁদে শুধু নিজের ক্ষুধার জ্বালায়। প্রতীকী অর্থে শিশু প্রার্থনা করে সকল শিশুর ক্ষুধা নিবারণে। এই সমাজে যারা ধনবান তারা পূজা বা ধর্মাচার করে তার অহঙ্কারকে সমৃদ্ধ করতে। প্রকৃত ভক্ত পূজা করে সকল মানুষের দুর্গতিনাশে। মা দুর্গাকে বলা হয় দুর্গতি নাশিনী মা। কল্যাণময়ী, মঙ্গলময়ী দেবী দুর্গা দুর্গতি নাশ করবে কীভাবে যদি ভক্ত দুর্গতি নাশের প্রার্থনা না করে! আড়ম্বরপূর্ণ বৈষয়িক ভাবধারা সমুন্নত রেখে পূজা করলে পৃথিবী ক্ষুধামুক্ত হবে না।
বিগত দুটো বছর করোনাঘাতে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। করোনা ছাড়াও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, খাদ্যাভাবসহ বিভিন্নভাবে মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। ঝলমলে এ পৃথিবীতে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কত মানুষ মারা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে পত্রিকায় এক রিপোর্টে প্রকশিত হয়েছে, ক্ষুধায় প্রতি চার সেকেন্ডে মারা যাচ্ছেন একজন। এএফপি, জেনেভার বরাত দিয়ে উক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে চরম ক্ষুধা নিয়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ১৯ হাজার ৭০০ মানুষ। এ হিসেবে বছরে মৃত্যুবরণ করছে ৭০,৯২,০০০ (সত্তর লাখ বিরানব্বই হাজার) মানুষ।
গত প্রায় তিন বছরে করোনায় মারা গেছে ৬৬ লাখের কিছু উপরে। তা হলে ক্ষুধা নামক এই ব্যাধিটি করোনার চেয়েও কত ভয়াবহ। আমরা মেনে নিচ্ছি করোনা একটি অচেনা ব্যাধি। এটি মহামারী। এর বিরুদ্ধে কত কী করেছি আমরা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছি করোনা ভ্যাকসিনে। কিন্তু ক্ষুধা দারিদ্র্যতা তো চিহ্নিত রোগ, এটা মানবসৃষ্ট। পৃথিবীতে ধনবানদের অভাব নেই, কত গল্প চিত্র প্রকাশিত হয় এ নিয়ে। ক্ষুধা নিবারণে ধনবানদের কী করণীয় বিশ্ব নেতারা কী তা সুনির্দিষ্ট করেছেন? করেননি। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছে। ৭৫টি দেশের মানবোন্নয়ন কাজে নিয়োজিত ২৩৮ বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) এ তালিকায় অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের মতো বিশ্ব খ্যাত সংস্থাও রয়েছে। চিঠিতে ক্ষুধায় প্রাণ হারানো মানুষের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বৈশ্বিক ক্ষুধা পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বর্তমান শতকে সোমালিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ৪৫টি দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ অনাহারের মুখে রয়েছে। অথচ বিনা কারণে বিভিন্ন দেশ অস্ত্র গোলাবারুদের পেছনে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছে। অনাহূত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মানব সভ্যতাকে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে। ধনীদের ধারণা, পূর্ব জন্মের পুণ্যের ফলেই তারা ধনী হয়েছেন এবং তাদের সন্তানরা মহাপুণ্য করে ধনীর দুলাল হয়ে জন্মেছে। কিন্তু মা দুর্গার কাছে কোন ভেদাভেদ আছে? তাই আজ বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করতে মাতৃ সাধনায় ব্রতী হওয়ার জন্য সকল হিন্দু সম্প্রদায়কে মিনতি করছি। দেবী দুর্গা কেবল হিন্দুদের জন্যই নয়, তিনি সকল মানবের কল্যাণে আবির্ভূত হন জগতে। মাতৃ সাধনের মধ্য দিয়ে ঘুচে যায় সকল ভাবদ্বন্দ্ব, সকল পার্থক্য, প্রস্ফুটিত হয়, সমন্বয়ের ভাব। বাস্তবতার নিরিখে দেবী দুর্গামায়ের কাছে প্রার্থনা সকল মানুষের মধ্যে যেন ক্ষুধা দারিদ্র্য মেটানোর শক্তি জাগ্রত হয়। সকল ধনবানের মধ্যে যেন ধনভাব দূর হয়ে বিকশিত হয় প্রেমভাব।

 লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

 

×