ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভোক্তার অভিযোগ প্রতিকারের উপায়

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

ভোক্তার অভিযোগ প্রতিকারের উপায়

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদফতরে (ডিএনসিআরপি)

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদফতরে (ডিএনসিআরপি) ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৭৬৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর আগের অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা ছিল নয় হাজার ১৯৫টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিএনসিআরপি’র কাছে বিভিন্ন বিষয়ে সাত হাজার ৫১৫টি অভিযোগ এসেছিল। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডিএনসিআরপি ২০১৩-১৪ অর্থবছর এখন পর্যন্ত মোট ৪৭ হাজার ৭৩৮টি অভিযোগ পেয়েছে। তবে, সাম্প্রতিককালে অনলাইনে বেচাকেনার ক্ষেত্রে প্রতারণার ঘটনা বেড়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৪৪ হাজার ৬৩০টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ছয় হাজার ৯৩৫টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভোক্তা অধিকার অধিদফতরে আসা অভিযোগগুলোর ৮০ শতাংশই অনলাইন কেন্দ্রিক কেনাকাটায় প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে। এসব অভিযোগের মধ্যে আছে, পণ্য সরবরাহে দেরি হওয়া, এক পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য সরবরাহ করা অথবা রিফান্ড পেতে দেরি হওয়া। এ ছাড়া, কেউ চাইলে কোর্টে গিয়ে বা দেওয়ানী প্রতিকার চাইলে দেওয়ানী আদালতে গিয়ে বা প্রতারণার মামলাও করতে পারেন। তবে, ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ পাবেন।
ডিএনসিআরপি’র নিরীক্ষণ অভিযানের সংখ্যা ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় এখন ৭০ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১১ হাজার ৯৫৩টি বাজার অভিযান হয়েছে, যার মাধ্যমে ২২ হাজার ৯৯৬ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে এবং বড় আকারের মূল্য ছাড়ের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। এছাড়াও ক্রয় তথা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করার সুযোগ থাকতে হবে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মতো সংস্থাগুলো যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তাহলে ভোক্তা অধিকার সম্পর্কিত এত অভিযোগ আসতো না। তথাপি আমাদের দেশে ভোক্তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। যদি কোন ভোক্তা প্রতারণার শিকার হন, তিনি সেটাকে ভাগ্যের ফের হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে ভোক্তারা বিগত বছরের তুলনায় এখন অনেক বেশি সচেতন। এ বিষয়টি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে খুবই ইতিবাচক। কেননা ভোক্তারা যত বেশি সচেতন হবেন, ব্যবসায়ীরা তত বেশি অসাধু কাজ থেকে বিরত হবেন।
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৭৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, যে কোন ব্যক্তি, যিনি সাধারণভাবে একজন ভোক্তা বা ভোক্তা হতে পারেন, এই অধ্যাদেশের অধীনে ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজ সম্পর্কে মহাপরিচালক বা এই উদ্দেশ্যে মহাপরিচালকের কাছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবহিত করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে জানানো অভিযোগটি অবশ্যই লিখিত হতে হবে। ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েবসাইট বা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমেও অভিযোগ জানানো যায়। তবে, অভিযোগের সঙ্গে অবশ্যই পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রশিদ সংযুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া অভিযোগকারীকে তার পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করতে হবে।
অভিযোগ ফরমটি পূরণ করে রাজধানীর কাওরান বাজারে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সব বিভাগীয় শহরের জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করা যায়। এ ছাড়া ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ওয়েবসাইটে গিয়ে ফ্যাক্স, ই-মেইল আইডি সংগ্রহ করে অনলাইনেও অভিযোগ জানাতে পারেন। অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের ওয়েবসাইটে গিয়ে অভিযোগ ফরম ডাউনলোড করে সেটা পূরণ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এ্যাটাচ করে ই-মেইলে পাঠালে অভিযোগ জমা হয়ে যাবে। অভিযোগ ফরম পূরণ করে ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের অফিসে গিয়ে অথবা ফ্যাক্স করেও অভিযোগ জমা দেয়া যাবে। ই-মেইলে বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া অভিযোগগুলো সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে ফরোয়ার্ড করে দেয়া হয়। কেউ চাইলে জেলা অফিসে গিয়ে বা সেই জেলার ই-মেইলেও অভিযোগ জানাতে পারেন।
পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়ে থাকলে ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ পাঁচ দিন এবং ভিন্ন শহরে বা গ্রামে অবস্থিত হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে ডেলিভারির সময় আরও সংক্ষিপ্ত হবে এবং ক্রেতাকে তা ক্রয়াদেশ গ্রহণের সময় সুস্পষ্টভাবে অবহিত করতে হবে। একটি ক্রয়াদেশে একাধিক পণ্য থাকলে আলাদা আলাদা পণ্যের জন্য সাধারণত আলাদা আলাদা ডেলিভারি চার্জ আরোপ করা যাবে না। তবে, মার্কেটপ্লেসে পণ্যে আলাদা আলাদা ডেলিভারি প্রদান করা হলে আলাদা আলাদা চার্জ গ্রহণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতাকে ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করার সময় বা ইনভয়েসে আগেই জানাতে হবে। পণ্য সরবরাহের সময় মুদ্রিত বিল প্রদান করতে হবে, যাতে প্রদেয় বা প্রদত্ত ভ্যাট ও আয়কর (যদি থাকে) উল্লেখ থাকতে হবে।
সুস্পষ্টতার জন্য বাস্তবসম্মত হলে পণ্যের ছবি, ভিডিও, রং, আকৃতি, পরিমাপ, ওজন ও উপাদান ইত্যাদি এবং সেবার ক্ষেত্রে সেবার ধরন, সেবা প্রদান পদ্ধতি, পরিমাপ যোগ্যতা (যদি থাকে) ইত্যাদি তথ্য প্রদান করতে হবে। পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ (ব্র্যান্ড, মডেল, ডেলিভারি সময় ইত্যাদি) ক্রেতাদের জন্য দিতে হবে, যাতে ক্রেতা জেনে-বুঝে পণ্য বা সেবা ক্রয় করতে পারে। বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্য বিক্রেতা বা তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে এবং বিজ্ঞপ্তিতে কি পরিমাণ পণ্য স্টকে রয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে এবং প্রতিটি বিক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই পণ্যের স্টক হালনাগাদ করতে হবে।
অগ্রিম মূল্য আদায়ের ক্ষেত্রে প্রদর্শিত পণ্য অবশ্যই দেশের ভেতরে রেডি টু শিপ মার্কেটপ্লেসের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে বা মার্কেটপ্লেসে নিবন্ধিত থার্ড পার্টি (বিক্রেতার নিয়ন্ত্রণে) পর্যায়ে থাকতে হবে। সম্পূর্ণ মূল্য গ্রহণের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি পারসন বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় নেই এমন পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্যমূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অগ্রিম গ্রহণ করা যাবে না। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত এসক্রো সার্ভিসের মাধ্যমে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত অগ্রিম গ্রহণ করা যাবে। কোন ধরনের অফার, ডিসকাউন্ট, ফ্রি ডেলিভারি বা অন্য কোন সুবিধা থাকলে তা পরিষ্কারভাবে পণ্যের বর্ণনায় থাকতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৩৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধি দ্বারা কোন পণ্য মোড়কাবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, ব্যবহার-বিধি, সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রি মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, প্যাকেটজাতকরণের তারিখ এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে থাকলে তিনি অনুর্ধ এক বছর কারাদ- বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৪৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনুর্ধ এক বছর কারাদ- বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করলে তিনি অনুর্ধ এক বছর কারাদ- বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। ৫৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনে উল্লিখিত কোন অপরাধের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তি যদি আবারও একই অপরাধ করেন তবে তিনি উক্ত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যে দ- রয়েছে তার দ্বিগুণ দণ্ডে- দণ্ডিত হবেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৬০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এই আইনের অধীন ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজ সম্পর্কে মহাপরিচালক কিংবা অধিদফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ না করলে ওই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৭৬(৫) ধারা অনুযায়ী, আদালত বা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নিয়মিত ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হলে এবং নিয়মিত মামলায় অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা করা হলে এবং জরিমানার অর্থ আদায় করা হলে, তার ২৫ শতাংশ অর্থ উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অভিযোগকারীকে প্রদান করতে হবে। তবে অভিযোগকারী অধিদফতরের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী হয়ে থাকলে তিনি এই উপধারায় উল্লিখিত আদায় করা অর্থের ২৫ শতাংশ পাবেন না।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×