ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান কোন পথে

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান কোন পথে

রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান কোন পথে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জান্তা বাহিনী ও সশস্ত্র আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে। সীমান্ত এলাকায় আরাকান আর্মির ঘাঁটি। সেখানেই জান্তা বাহিনী মর্টারশেল ও গোলা নিক্ষেপ করছে। আশঙ্কার বিষয়, তাদের ছোঁড়া মর্টারশেল ও গোলা এসে পড়ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করছে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার। সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে আসা গোলা সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরিত হলে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হওয়ার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। একই দিনে সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশী যুবকের পা উড়ে যায়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলা-মর্টারশেল নিক্ষেপ ও বাংলাদেশের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশের ঘটনা প্রমাণ করে যে, মিয়ানমারের জান্তা সরকার কতটা দুর্বিনীত ও বেপরোয়া। এমন অযাচিত, অপ্রতিবেশীসুলভ ও উস্কানিমূলক আচরণ বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন ক্ষত। এই ধরনের আচরণ আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও জাতিসংঘ সনদের চরম অবমাননা।
মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাই কূটনীতির অংশ হওয়া উচিত। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল মন্ত্রই হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সুসম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রভাব নিজ অঞ্চলে পড়ার পরও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সংযম দেখাচ্ছে বলে তাৎপর্যবহ মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমরা কোন দেশের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষ চাই না। যুদ্ধ কিংবা বৈরিতা নয়, শান্তিপূর্ণভাবেই মিয়ানমার সমস্যার সমাধান চায় বাংলাদেশ। মিয়ানমারকেও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে আশ্রয়শিবিরে মর্টারশেল ও গোলা নিক্ষেপের ঘটনা পরিকল্পিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। কারণ, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী বহু আগে থেকেই আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা এটেছে! কিন্তু আশ্রয়শিবিরের পেছনে রাখাইন রাজ্যেই রোহিঙ্গাদের বাড়ি হওয়ায় এ স্থান ছেড়ে অন্যত্র যেতে রাজি নয় তারা। এমনিতেই মিয়ানমারে সংঘাতের জেরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বাংলাদেশকে টানতে হচ্ছে। যা আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল মানবিক বিবেচনায়।

রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বহুমুখী সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় ক্রমবর্ধমান অপরাধ বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। মাদক পাচারের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে শিবিরগুলো। সশস্ত্র অপরাধী দলগুলো নিয়মিত সংঘাতে লিপ্ত হয়, খুন-খারাবি-মাদক পাচার সেখানে নৈমিত্তিক ঘটনা। তাদের এসব কার্যকলাপ পরোক্ষভাবে মিয়ানমার জান্তার পক্ষে যাচ্ছে, যা কাম্য নয়। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত না নিয়ে উল্টো বাংলাদেশ সীমান্তে মর্টারশেল নিক্ষেপ করছে। মিয়ানমারের এই উস্কানি অব্যাহত থাকলে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করবে। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করবে। তাদের ছোড়া মর্টারশেল বা গোলা আর যাতে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।
বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে আসছে।

বারবার প্রতিবাদ জানানোর পরও মিয়ানমার যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিহার না করলে বাংলাদেশের বসে থাকলে চলবে না। বিষয়টি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। স্পষ্ট কথা, আমরা এটার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। শান্তিপূর্ণভাবেই বিষয়টির সমাধান করতে হবে। তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে থাকতে হবে সতর্কাবস্থায়। মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে সবসময় সজাগ থাকতে হবে।

নতুন করে কোন রোহিঙ্গা যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে বিজিবি-কোস্টগার্ড কাজ করছে। তারপরেও দুই একজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসছে। তাদের আবার পুশব্যাক করে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা নতুন করে যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের পক্ষপাতী বাংলাদেশ। এসব ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মো’কে গত রবিবার চতুর্থবারের মতো তলব করে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। সীমান্তে যে সমস্ত ঘটনা ঘটছে, সেগুলো যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে বিষয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সংযত হতে বলা হয়েছে। মিয়ানমারে যা ঘটছে সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

মিয়ানমারের মর্টারশেল ও গোলা যাতে আমাদের ভূখ-ে না আসে, এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদেরই। তবে পরিস্থিতি যদি আরও নেতিবাচক রূপ ধারণ করে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এ অবস্থায় বর্তমান ঘটনাসহ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত তো বটেই, অন্যান্য মিত্র দেশ যেমন- চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা যেতে পারে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অং সান সুচির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের জান্তা সরকার। এরপর থেকে অত্যাচার, নিপীড়ন বহুগুণে বেড়ে গেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ২ হাজার ২৪৯ জনকে। ফাঁসি দেয়া হয়েছে গণতন্ত্রপন্থী জ্যেষ্ঠ নেতাদের। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে। যারা অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, তাদেরও জেলে বন্দী করা হয়েছে কিংবা হত্যা করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে কমপক্ষে ২৮ হাজার বাড়িঘর। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। তারা কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, কেউ জানে না! মিয়ানমারের জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে থোড়াই কেয়ার করছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক জান্তা জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করলে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নবেম্বর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গাম্বিয়া। মামলার বিরুদ্ধে তোলা মিয়ানমারের বিভিন্ন আপত্তি খারিজ করে দিয়ে মামলা চলার পক্ষে রায় দিয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ বিচারিক এ সংস্থা। অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি মিয়ানমারের দাবি ছিল, গাম্বিয়ার এই মামলা করার অধিকার নেই এবং এই আদালতের বিচার করার এখতিয়ার নেই।

অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে মিয়ানমারের প্রতি কিছু নির্দেশনা দেয় আইসিজে। এতে রাখাইনে ঝুঁকিতে থাকা সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের সুরক্ষা দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরতে বলা হয়েছে। সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যে কোন নিরাপত্তাবাহিনী যাতে গণহত্যা না চালায় কিংবা উস্কানি না দেয়, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে এতে। অন্তর্বর্তীকালীন রায় বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে প্রবলভাবে।
মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিজভূমে পরবাসী। জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই দেশছাড়া! সর্বশেষ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর রাখাইন রাজ্যে। সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াইয়ের বলি সাধারণ রোহিঙ্গারাও। মিয়ানমারের জান্তা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলেছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে এবং সামরিক জান্তা সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে একঘরে করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

তবে একাধিক দেশ জান্তার কাছে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে, যা অশনিসঙ্কেত। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়। একই সঙ্গে নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে যাতে সামরিক বাহিনী প্রবেশাধিকার না পায়, সে জন্যও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা। মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কারণ, এসব মারণাস্ত্র চলে যাচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উস্কানিমূলক ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও রোহিঙ্গা নিধন অভিযান বর্বরতার নামান্তর। এরূপ আচরণ একদিকে যেমন রোহিঙ্গা সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুলছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে। তাই জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বৃহৎ শক্তিসমূহ ও আঞ্চলিক দেশগুলোর উচিত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করাও জরুরী। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের আগ্রাসী ও মানবতাবিরোধী কর্মকা- এখনই প্রতিহত করতে হবে। অন্যথায় দেশটি আরও নৃশংস ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।


লেখক : কোষাধ্যক্ষ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
bhui“[email protected]

×