ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধকরণ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২

ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধকরণ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

বিটকয়েনসহ সব ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট আর্থিক সঙ্কটের কারণে আমাদের দেশেও ডলার সঙ্কট এবং সেই সঙ্কট মোকাবেলা করার কারণেই হোক বা নতুন গবর্নরের নেতৃত্বে দেশের মুদ্রাবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই হোক; দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ ভালভাবেই নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা একদিকে যেমন বর্তমান সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে দেশের মুদ্রাবাজারের জন্য যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ ও দৃষ্টান্তমূলক। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে বিটকয়েনসহ সব ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য অনেক আগে থেকেই জনগণকে সতর্ক করে আসছে এই মর্মে যে, ভার্চুয়াল মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় বাংলাদেশে প্রচলিত আইন কোনভাবেই অনুমোদন করে না। তাই এ সংক্রান্ত লেনদেন বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের পূর্বঘোষিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থাকে এখন বেশ কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত আকারে জারি করেছে মাত্র। এ রকম কঠোর সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। যা হোক, দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভাল এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এজন্য তাদের সাধুবাদ।
বিশ্বব্যাপী এখনও ক্রিপ্টোকারেন্সি আর্থিক লেনদেনের অবৈধ মাধ্যম। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যেখানে সবচেয়ে বেশি ক্রিপ্টোর মালিকের বসবাস, সেখানেও এই ডিজিটাল মুদ্রা এখনও আইনগত স্বীকৃতি পায়নি। এসব কারণেই এই ধরনের অবৈধ ভার্চুয়াল বা আর্থিক সম্পদ অধিকাংশ দেশে অবৈধ। কোন লেনদেন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এই ভার্চুয়াল মুদ্রার তেমন কোন আইনগত ভিত্তি নেই। এরপরও এই ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে ইতোমধ্যে এবং বিশ্বে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের মুদ্রা বাজারে পরিণত হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সেখানে অনুমোদিত নয় এমন মুদ্রার বাজার কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেল কিভাবে? যে দেশে নাপিতের কাজ বা যেনতেন মাপের ব্যবসা করতে গেলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে করতে হয়, সেই দেশেই এই অবৈধ ভার্চুয়াল মুদ্রার প্রচলন হয়েছে। বিগত এক দশক ধরে এর রমরমা ব্যবসা চলছে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়।

কিন্তু এর বিরুদ্ধে এখানকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি। মাঝে মধ্যে এই মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে কিছু হুমকি-ধমকি দিয়েছে মাত্র। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সুনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাবাজার বলে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে ক্রিপ্টোকারেন্সি যে বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে, তা দেখে সেই পৌরাণিক কথা- ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’ মনে পড়ে। কারণ, এই ক্রিপ্টোকারেন্সিই আমেরিকার মুদ্রাবাজারে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য আমেরিকা এ বিষয়ে যথেষ্ট স্মার্ট তথা সচেতন। কারণ, তারা বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশে আমেরিকার মুদ্রা এবং মুদ্রাবাজারের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার বিষয়টি তাদের পক্ষে কাজে লাগিয়েছে খুব সুন্দরভাবে। এক্ষেত্রেও অবৈধ ভার্চুয়াল মুদ্রা যখন তাদের মুদ্রাবাজারে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করতে যাবে, তখন তারা এক রকম নিরুপায় হয়েই এই মুদ্রাকে আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে বিশৃঙ্খল মুদ্রাবাজারকে শৃঙ্খলার আবরণে ঢেকে ফেলতে পারে।

একটি অবৈধ বিনিময় বা লেনদেনের মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও এই ডিজিটাল মুদ্রা বা ভার্চুয়াল আর্থিক সম্পদ এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, পশ্চিমা বিশ্বে সব ডিজিটালে রূপান্তরের হিরিক বা এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। ফলে, মানুষ সব ডিজিটালে পেতে চায়। এমনকি অর্থও ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেতে উদগ্রীব হয়ে আছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা দীর্ঘসূত্রতার কারণে এখন পর্যন্ত ডিজিটাল লিগ্যাল টেন্ডার বা বৈধ ডিজিটাল মুদ্রা চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে, সেই স্থান খুব সহজেই ক্রিপ্টোকারেন্সি দখল করে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই ক্রিপ্টোকারেন্সির সূচনা এবং এর প্রসারের পেছনে শুরু থেকেই আছে উন্নত বিশ্বের, বিশেষ করে আমেরিকার অনেক বিত্তবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। বর্তমান সমাজে তাদের প্রতিপত্তি ও প্রভাব এতই যে, তারা বাজারে যে প্রোডাক্ট বা সেবা নিয়ে আসবে, তা একপর্যায় গ্রহণযোগ্যতা পেতে বাধ্য।
তাছাড়াও বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের দেশে বিনিয়োগের ওপর আয় একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে, বলা যায় শূন্যের কাছাকাছি বিরাজ করছে। এখানে ব্যাংকে টাকা রাখলে এক পয়সাও বৃদ্ধি পায় না, উল্টো অনেক ক্ষেত্রে কমতে থাকে। এমনকি বন্ডে বা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করলেও রিটার্ন পাওয়া যায় না সেভাবে। এহেন পরিস্থিতিতে অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রয়-বিক্রয় করে অনেকেই ভাল লাভ করতে পেরেছে- এমন কথা বেশ জোরেশোরেই প্রচলিত আছে। আর এই প্রচারণায় কান দিয়ে একটি অংশ বেপরোয়া হয়ে বিনিয়োগ করেছে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে। তাছাড়া, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের কঠোর প্রয়োগের ফলে প্রচলিত মুদ্রা যেমন- ডলার বা ইউরোতে অর্থপাচার এবং অবৈধ বা নিষিদ্ধ লেনদেন সম্পন্ন করা বেশ কষ্টকর হয়ে গেছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রচলন বিশ্বব্যাপী অর্থপাচার, মানি লন্ডারিং বা অবৈধ লেনদেনের কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির কারণে বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং, অর্থপাচার এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের ঘটনা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, বিগত দুই যুগ ধরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, মানসম্পন্ন কমপ্লায়েন্স এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী অর্থপাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, অবৈধ আর্থিক লেনদেন এবং মানি লন্ডারিংয়ের মতো ঘটনা বন্ধে যতটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তার পুরোটাই শেষ হয়ে যেতে বসেছে এই ক্রিপ্টোকারেন্সির কারণে। এখন কোন দেশের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও যে তা আর খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না, তারও অনেক কারণের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করার সহজ সুযোগ।      
এসব কারণেই অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও এই ভার্চুয়াল মুদ্রা এখন অনেকের কাছে খুব জনপ্রিয় এবং লাভজনক বিনিয়োগের মাধ্যম। ফলে, অনেকেই বুঝে না বুঝে অতি লাভের মোহে পড়ে এই মুদ্রায় বিনিয়োগ করছেন। হাতেগোনা কয়েকজন কিছু লাভের চেহারা দেখলেও অনেকেই গুনছেন ক্ষতি। আমাদের দেশের কিছু মানুষের মধ্যে যেহেতু হুজুগে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা আছে, তাই তারা খুব সহজেই ক্রিপ্টোর লোভের ফাঁদে পা দিতে পারে। সুতরাং, তাদের আগে থেকেই সতর্ক করতে হবে এবং নানারকম নিষেধাজ্ঞার আবরণে আটকে রাখতে হবে।

যাতে করে হুজুগে বিনিয়োগকারীরা কোন অবস্থাতেই অবৈধ এই ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত না হয়। একটি কথা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে যে, ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগে দুই ধরনের ঝ্ুঁকি থাকে। প্রথমত, এই ভার্চুয়াল মুদ্রা যেহেতু অবৈধ এবং কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নেই, তাই এর মূল্য ওঠানামার ক্ষেত্রে সবসময় বিরাজ করে অস্বাভাবিক অবস্থা। ফলে, এই মুদ্রায় লেনদেন করে মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। তাছাড়াও অবৈধ মুদ্রা হওয়ায় এই মুদ্রা ক্রয়বিক্রয় নিয়ে জাল-জালিয়াতির ঘটনা অনেক বেশি ঘটে। এমন সব উন্নতমানের কোম্পানি ক্রিপ্টোকারেন্সি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত যে, তাদের খালি চোখে দেখে চেনার উপায় নাই।

ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানি খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, একই রকমের বেশ কয়েকটি কোম্পানি চালু আছে এবং এগুলোর মধ্য থেকে কোন্টি আসল, আর কোন্টি নকল- তা পৃথক করা সম্ভব হয় না। ফলে, সমূহ সম্ভাবনা থাকে ভুল কোম্পানিকে বেছে নিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন করে সর্বস্বান্ত হওয়ার। পশ্চিমা বিশ্বে বসবাস করে পরিচিত দু’একজন ইতোমধ্যে এরকম সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা তো আছেই, তার চেয়েও বড় কথা নিজেদের স্বার্থেই এই অবৈধ মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ থেকে সাত হাত দূরে থাকা উচিত।
অবৈধ ভার্চুয়াল মুদ্রা হওয়া সত্ত্বেও ক্রিপ্টোকারেন্সির মোট বাজার এবং এর বিস্তৃতি এত বিশাল আকার ধারণ করেছে যে, খুব সহসাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের সব দেশ তো বটেই, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশও এই ভার্চুয়াল মুদ্রাকে নিয়ন্ত্রণে আনার নামে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হবে। অবস্থা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, তারা যদি ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে ক্রিপ্টোকারেন্সিই তাদের উল্টো নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে।

এই অবস্থা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। তাই বাস্তবতার আলোকে খুব সহসাই এই ভার্চুয়াল মুদ্রা হয়ত বৈধতা বা স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু যতক্ষণ সেটা না হবে, ততক্ষণ এই মুদ্রায় বিনিয়োগ একদিকে যেমন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে অবৈধও বটে। সে কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসময়ে যথার্থই এই অবৈধ মুদ্রার লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখন সকলেই কঠোরভাবে এই সিদ্ধান্ত মেনে চলবে নিশ্চয়ই। বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক্ষেত্রে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। এই কারণে যে তাদের প্রোডাক্ট বা চ্যানেল ব্যবহার করে যেন কেউ কোন অবস্থাতেই ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রয়বিক্রয় করতে না পারে। আর তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্য ও সাফল্য অর্জিত হবে।

লেখক : সার্টিফাইড এ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার
টরন্টো, কানাডা
[email protected]

×