বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পরিবার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন একক ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। তিনি একটি রাষ্ট্রের প্রতিবিম্ব। যার মধ্যে রয়েছে আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তির ঐক্যতান। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার রূপকার ও অবিসংবাদিত অকুতোভয় নেতা। জাতির জন্য ‘স্বাধীনতা’ এনে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বদরবারে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতিও আদায় করেছিলেন। ভাল কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে খুব অল্প সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং দেশেকে এগিয়ে নিতে গ্রহণ করেন নানা পদক্ষেপ।
কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র সর্বদা দেশের অগ্রগতি থামানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ফলে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পরই এই মহানায়ককে পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের ভয়ঙ্কর দিন ১৫ আগস্ট। ইতিহাসের জঘন্যতম সেই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু স্বাধীনতার স্থপতিকেই হারায়নি বাঙালী, দীর্ঘকালের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় জীবনের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল তাও উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে। এ হত্যাকাণ্ডে আমরা যেমন শোকে মুহ্যমান ও বেদনাবিধুরতায় নিমজ্জিত হই, তেমনি অনুতপ্তও হই।
যে মানুষটি বিশ্বের বুকে বাঙালীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাকেই আমরা সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছি! এমন জাতি পৃথিবীতে বিরল। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার জেঁকে বসে দেশের বুকে যে স্বপ্ন-চেতনায় স্বাধীন হয়েছিল দেশ তাও হয় অবদমিত। দুই দশকের বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই থেকে যান অগোচরে। উপেক্ষিত থেকে যায় তার নীতি-আদর্শ। বিকৃত করা হয় দেশের ইতিহাস।
কী বীভৎস ছিল সেই রাত! একটি বাড়ি থেকে রক্ত গঙ্গা বইছে, সবকিছু এলামেলো আর প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু লাশ হয়ে। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে যখন স্মরণ করেছে জাতি, তখন সঙ্গত কারণেই নবীন প্রজন্মকেও স্মরণ করিয়ে দিতে হবে– তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি নিজের জীবনের চেয়ে দেশের মানুষকে বেশি ভালবাসতেন।
ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও যিনি পাকিস্তানী কারাগারে বসে আপোস করেননি স্বাধীনতার প্রশ্নে। ভয়ঙ্কর কালরাত ১৫ আগস্টেও ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও ছিলেন অকুতোভয়। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ তিনি সেই অনির্বাণ সূর্যের প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তার আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না। মানুষের মৃত্যু অবধারিত কিন্তু আদর্শ অমর। এমন ব্যক্তির জীবনযাপন, চলাফেরা ও কথাবার্তা সবকিছুই অনুকরণীয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের সে হীন চক্রান্ত সফল হয়নি।
হিংস্র ঘাতকের দর্পচূর্ণ করে বাংলাদেশ বর্তমানে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে। ফলে শোক ও স্মরণে তার সকল কার্যক্রম ও চিন্তাধারাকে আমরা নিজের ব্যক্তি জীবনে লালন-পালন করতে পারলে দেশের জন্যই হবে মঙ্গল। বাংলার আকাশে কালো মেঘের আনাগোনার দিন হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কারণ, এই দিনে স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতার পরিবারসহ ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বারবার মিডিয়াতে বলার চেষ্টা করে যে, তারা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নয়, বরং নিজেরাই বুদ্ধি-পরামর্শ করে তাকে হত্যা করে।
এমন জঘন্য কাজের পর তাদের মধ্যে কোন ধরনের অনুশোচনা, অনুতাপ বলে মনে হয়নি। তারা স্বীকার না করলেও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের মদদে এই হত্যাকা- সংগঠিত হয়। হত্যার আগে ওই দুই দেশ থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিয়মিত ঢাকা সফর করতে শুরু করে। তবে কাজটি করার পর সবাই ভেবে অবাক হন যে, এমন মানুষকে আসলেই হত্যা করা সম্ভব কিনা? এই ঘটনায় মূল দায়ী হিসেবে আমরা প্রায় সকলেই যাদের নাম জানি তারা হলো, খন্দকার মোশতাক, কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, মেজর ডালিম। তারা মূলত ঘাতকের কাজটি করলেও পর্দার আড়ালে থাকে বিদেশী রাষ্ট্রের পরিকল্পনাকারী ও এজেন্টরা।
তারা এমনভাবে পরিকল্পনা করেছিল যে, কাজটি হওয়ার পর যেন তারা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারে। তেমনটাই হয়েছিল আর এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন নারকীয় একটি হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হবে সেটি কল্পনারও বাইরে ছিল। এরপর দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন লোভী মোশতাক। ফলে স্বাধীন দেশে শুরু হয় ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়। খুব অল্প দিনের মধ্যে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূলনীতি হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু সর্বদা চাইতেন দেশের সকল মানুষের ধর্মচর্চার জায়গা থাকবে স্বাধীন। যার যা ইচ্ছে সেভাবে ধর্ম পালন করবে। প্রতিটি ধর্মের মানুষ সমান সম্মান ও অধিকার নিয়ে দেশে বসবাস করতে পারবেন। দেশের প্রতিটি সিদ্ধান্ত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। যে কোন কাজে দেশের প্রতিটি মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হবে। আর দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ তারা এক সঙ্গে বাংলাদেশী হিসেবে বসবাস করবে। সকলের অধিকার সব ক্ষেত্রে সমান থাকবে। দেশে কোন শ্রেণী বৈষম্য থাকবে না।
সবাই সবকিছুতে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলই এই চারটি মূলনীতির বিষয়ে কাজ করেনি। বরং তারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তৈরি এবং সেভাবে কাজের নকশা করে। দেশের মানুষের মধ্যে সমান অধিকারের বিষয়ে কখনও সোচ্চার ছিল না। এসবই ছিল দেশের অগ্রগতির মূল বাধা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুব ভোরে বাংলাদেশের মানুষ কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না যে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, তিনি শুধু একটি দেশের রাষ্ট্রপতি বা রাজনৈতিক নেতা নন, দেশের সকল মানুষের আস্থার ব্যক্তিত্ব। আসলেই তার মতো ব্যক্তিকে যে হত্যা করা সম্ভব, সেটি কল্পনাও করত না বাংলার সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধু মানেই তখন ছিল দেশ।
এই কালো রাতের পর থেকে দেশের সকল গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে শুরু করে সামরিক লোকজন। এতে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দের জায়গা সংকুচিত হতে থাকে। ঘন ঘন সামরিক শাসক পরিবর্তন হলেও দেশের কোন লাভ হয়নি। এই নৃশংস হত্যাকা- না ঘটলে দেশ আরও আগে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াত। অর্থনৈতিক অবস্থা আরও অনেক বেশি মজবুত হতো। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আরও অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হতো। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।
বাবার আদর্শে গড়া দলকে আবারও নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং বিকৃত ইতিহাস মুছে মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রজন্মের সামনে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং প্রতিষ্ঠাতা
সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ