ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শোক থেকে শক্তি

ড. সাজ্জাদ হোসেন

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ১৬ আগস্ট ২০২২

শোক থেকে শক্তি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পরিবার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন একক ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নামতিনি একটি রাষ্ট্রের প্রতিবিম্বযার মধ্যে রয়েছে আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তির ঐক্যতানতিনি ছিলেন স্বাধীনতার রূপকার ও অবিসংবাদিত অকুতোভয় নেতাজাতির জন্য স্বাধীনতাএনে দিয়েছিলেন তিনিবিশ্বদরবারে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতিও আদায় করেছিলেনভাল কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে খুব অল্প সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং দেশেকে এগিয়ে নিতে গ্রহণ করেন নানা পদক্ষেপ

কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র সর্বদা দেশের অগ্রগতি থামানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলফলে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পরই এই মহানায়ককে পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীরাবেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের ভয়ঙ্কর দিন ১৫ আগস্টইতিহাসের জঘন্যতম সেই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু স্বাধীনতার স্থপতিকেই হারায়নি বাঙালী, দীর্ঘকালের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় জীবনের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল তাও উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেএ হত্যাকাণ্ডে আমরা যেমন শোকে মুহ্যমান ও বেদনাবিধুরতায় নিমজ্জিত হই, তেমনি অনুতপ্তও হই

যে মানুষটি বিশ্বের বুকে বাঙালীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাকেই আমরা সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছি! এমন জাতি পৃথিবীতে বিরলফলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার জেঁকে বসে দেশের বুকে যে স্বপ্ন-চেতনায় স্বাধীন হয়েছিল দেশ তাও হয় অবদমিতদুই দশকের বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই থেকে যান অগোচরেউপেক্ষিত থেকে যায় তার নীতি-আদর্শবিকৃত করা হয় দেশের ইতিহাস

কী বীভস ছিল সেই রাত! একটি বাড়ি থেকে রক্ত গঙ্গা বইছে, সবকিছু এলামেলো আর প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু লাশ হয়েতলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরানিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটিস্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে যখন স্মরণ করেছে জাতি, তখন সঙ্গত কারণেই নবীন প্রজন্মকেও স্মরণ করিয়ে দিতে হবেতিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি নিজের জীবনের চেয়ে দেশের মানুষকে বেশি ভালবাসতেন

ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও যিনি পাকিস্তানী কারাগারে বসে আপোস করেননি স্বাধীনতার প্রশ্নেভয়ঙ্কর কালরাত ১৫ আগস্টেও ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও ছিলেন অকুতোভয়প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ তিনি সেই অনির্বাণ সূর্যের প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তার আদর্শের মৃত্যু হতে পারে নামানুষের মৃত্যু অবধারিত কিন্তু আদর্শ অমরএমন ব্যক্তির জীবনযাপন, চলাফেরা ও কথাবার্তা সবকিছুই অনুকরণীয়বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছেকিন্তু তাদের সে হীন চক্রান্ত সফল হয়নি

হিংস্র ঘাতকের দর্পচূর্ণ করে বাংলাদেশ বর্তমানে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বেফলে শোক ও স্মরণে তার সকল কার্যক্রম ও চিন্তাধারাকে আমরা নিজের ব্যক্তি জীবনে লালন-পালন করতে পারলে দেশের জন্যই হবে মঙ্গলবাংলার আকাশে কালো মেঘের আনাগোনার দিন হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টকারণ, এই দিনে স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতার পরিবারসহ ১৮ জনকে হত্যা করা হয়ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বারবার মিডিয়াতে বলার চেষ্টা করে যে, তারা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নয়, বরং নিজেরাই বুদ্ধি-পরামর্শ করে তাকে হত্যা করে

এমন জঘন্য কাজের পর তাদের মধ্যে কোন ধরনের অনুশোচনা, অনুতাপ বলে মনে হয়নিতারা স্বীকার না করলেও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিশ্বের বৃহ শক্তিদ্বয়ের মদদে এই হত্যাকা- সংগঠিত হয়হত্যার আগে ওই দুই দেশ থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিয়মিত ঢাকা সফর করতে শুরু করেতবে কাজটি করার পর সবাই ভেবে অবাক হন যে, এমন মানুষকে আসলেই হত্যা করা সম্ভব কিনা? এই ঘটনায় মূল দায়ী হিসেবে আমরা প্রায় সকলেই যাদের নাম জানি তারা হলো, খন্দকার মোশতাক, কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, মেজর ডালিমতারা মূলত ঘাতকের কাজটি করলেও পর্দার আড়ালে থাকে বিদেশী রাষ্ট্রের পরিকল্পনাকারী ও এজেন্টরা

তারা এমনভাবে পরিকল্পনা করেছিল যে, কাজটি হওয়ার পর যেন তারা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেতেমনটাই হয়েছিল আর এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন নারকীয় একটি হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হবে সেটি কল্পনারও বাইরে ছিলএরপর দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন লোভী মোশতাকফলে স্বাধীন দেশে শুরু হয় ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়খুব অল্প দিনের মধ্যে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে ওঠে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূলনীতি হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রবঙ্গবন্ধু সর্বদা চাইতেন দেশের সকল মানুষের ধর্মচর্চার জায়গা থাকবে স্বাধীনযার যা ইচ্ছে সেভাবে ধর্ম পালন করবেপ্রতিটি ধর্মের মানুষ সমান সম্মান ও অধিকার নিয়ে দেশে বসবাস করতে পারবেনদেশের প্রতিটি সিদ্ধান্ত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়যে কোন কাজে দেশের প্রতিটি মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হবেআর দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ তারা এক সঙ্গে বাংলাদেশী হিসেবে বসবাস করবেসকলের অধিকার সব ক্ষেত্রে সমান থাকবেদেশে কোন শ্রেণী বৈষম্য থাকবে না

সবাই সবকিছুতে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেনবঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলই এই চারটি মূলনীতির বিষয়ে কাজ করেনিবরং তারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তৈরি এবং সেভাবে কাজের নকশা করেদেশের মানুষের মধ্যে সমান অধিকারের বিষয়ে কখনও সোচ্চার ছিল নাএসবই ছিল দেশের অগ্রগতির মূল বাধা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুব ভোরে বাংলাদেশের মানুষ কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না যে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছেকারণ, তিনি শুধু একটি দেশের রাষ্ট্রপতি বা রাজনৈতিক নেতা নন, দেশের সকল মানুষের আস্থার ব্যক্তিত্বআসলেই তার মতো ব্যক্তিকে যে হত্যা করা সম্ভব, সেটি কল্পনাও করত না বাংলার সাধারণ মানুষবঙ্গবন্ধু মানেই তখন ছিল দেশ

এই কালো রাতের পর থেকে দেশের সকল গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ হয়ে যায়রাষ্ট্র পরিচালনা করতে শুরু করে সামরিক লোকজনএতে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দের জায়গা সংকুচিত হতে থাকেঘন ঘন সামরিক শাসক পরিবর্তন হলেও দেশের কোন লাভ হয়নিএই নৃশংস হত্যাকা- না ঘটলে দেশ আরও আগে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতঅর্থনৈতিক অবস্থা আরও অনেক বেশি মজবুত হতোবঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আরও অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হতোএই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন

বাবার আদর্শে গড়া দলকে আবারও নেতৃত্ব দিতে শুরু করেনপরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং বিকৃত ইতিহাস মুছে মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রজন্মের সামনে নিয়ে আসেনপরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেনবর্তমানে তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে

 

লেখক : অধ্যাপক, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং প্রতিষ্ঠাতা

সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ

×