নতুন বছরের প্রথম দিনেই প্রাথমিক স্তরের কয়েক লাখ কচিকাঁচা শিশু শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে ঝকঝকে-তকতকে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে বর্তমান জনবান্ধব সরকারের অন্যতম একটি অর্জন, যা প্রশংসিত হয়েছে ইউনেস্কো, জাতিসংঘ কর্তৃক। সম্ভবত বিশ্বের অন্য কোন দেশে, অন্য কোথাও এ রকম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষা জীবনের শুরুতেই একজন শিশু শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই প্রাপ্তির বিষয়টি প্রায় একটি স্বপ্নের মতো। আশৈশব লালিত যে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সে প্রবেশের অবারিত সুযোগ পেয়ে থাকে শিক্ষা জীবনে অনুপ্রবেশের। কয়েক কোটি শিশুর এই অনাবিল আনন্দ মা-বাবাসহ সমগ্র দেশবাসীকে অভিভূত ও আনন্দিত করে তোলে নিশ্চয়ই। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
সরকার ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার কপি বই ছেপেছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৩৭৫ কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯ কপি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হবে বিনামূল্যে। এর বাইরেও কিছু বই ছাপা হয়ে থাকে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের জন্য। ইতোমধ্যে ৯৯ শতাংশ বই পৌঁছে গেছে উপজেলা শিক্ষা অফিসসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এতে সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে এক হাজার ১১ কোটি টাকার বেশি। নিঃসন্দেহে বিশাল অঙ্কের সুবিশাল একটি কর্মকা-। প্রায় চার শ’ প্রতিষ্ঠান এসব বই মুদ্রণ ও সরবরাহের কাজে জড়িত। এটি বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি ধারাবাহিক সাফল্য, যা বাস্তবায়িত হচ্ছে ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে। নতুন বছরের শুরুতেই দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয় বিনামূল্যের এই বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবই, যা ইতোমধ্যে পরিণত হয়েছে জাতীয় উৎসবের পর্যায়ে। তবে যা দুঃখজনক তা হলো, প্রায় প্রতিবছরই পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, সরবরাহ ও বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে, যার অনেকাংশই অসত্য নয়। উদাহরণস্বরূপ কাগজের কথা বলা যায়। এত বিপুলসংখ্যক বইয়ের কাগজ কিনে দেয় এনসিটিবি, ৩৪০টি লটের বই মুদ্রণের কাগজ। তবে একশ্রেণীর অসাধু প্রিন্টার্স তথা মুদ্রক সরকারের ভালমানের কাগজ খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে নি¤œমানের কাগজ কিনে বই ছাপে। ফলে স্বভাবতই ছবিসহ মুদ্রণ সৌকর্যের বিনাশ ঘটে। পাশাপাশি নি¤œমানের ছাপা, বানান বিভ্রাট, অস্পষ্ট ছবি, দুর্বল বাঁধাই এমনকি ফর্মার হেরফের তো আছেই। এনসিটিবির পরিদর্শক টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে লিখিত ও মৌখিকভাবে সতর্ক করে দিলেও প্রশ্ন হলো, প্রতিবছরই তা হবে কেন?
দেশে যে প্রতিবছরই পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও সরবরাহ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে, তার ভয়াবহ ও আশঙ্কাজনক বিবরণ মেলে টিআইবির প্রতিবেদনে। উল্লেখ্য, এই কাজটির দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টি সুবিদিত। ইতোপূর্বে মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কট্টর মতাদর্শ ও পরামর্শে পাঠ্যপুস্তকের মর্জিমাফিক পরিবর্তনসহ ভুল মুদ্রণের অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। ব্যাপক আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতির অভিযোগ তো আছেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীর কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে আগাম জানিয়ে দেয় প্রাক্কলিত ব্যয়। কেউ কেউ এমনকি নামে-বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিক। পা-ুলিপি প্রণয়নের নামে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়াসহ অফিসে বসেই শেয়ার ব্যবসা, এনজিও পরিচালনাসহ মুদ্রণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার অভিযোগও আছে। আছে বিপুল আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে সহায়ক পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য। গোটা বিষয়টি পড়ে গেছে সিন্ডিকেটের খপ্পরে এবং এর নেতৃত্বে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে নানা কথা বললেও প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর তেমন কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। সে অবস্থায় এনসিটিবির ভাবমূর্তি রক্ষার্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট, সতর্ক ও উদ্যোগী হতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
শীর্ষ সংবাদ: