ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া  কঠিন হয়ে উঠছে, ৯ দেশে বন্ধ

মীর্জা মসিউজ্জামান

প্রকাশিত: ০০:২৯, ২৬ জুলাই ২০২৫

বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া  কঠিন হয়ে উঠছে, ৯ দেশে বন্ধ

.

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমনের জন্য বাংলাদেশিদের ভিসা প্রাপ্তি কঠিন  হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যেসব দেশে শ্রমবাজার রয়েছে সে সকল দেশ বাংলাদেশ থেকে নিজেদের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের অসৎ উপায় অবলম্বন করার কারণে ভিসা প্রাপ্তি ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। 
অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশের ভিসাপ্রাপ্তিতে কিছু জটিলতা তৈরি হলেও নিজেদের স্বচ্ছতা, সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতামূলক অভিবাসন নিশ্চিত করতে পারলে এ সমস্যার দ্রুতই সমাধান সম্ভব।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন উয়িং এবং  সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চল, পূর্ব ইউরোপ এমনকি  প্রতিবেশী ভারতের পক্ষ থেকেও একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবস্থান, জাল নথিপত্রের ব্যবহার এবং অভিবাসীদের আচরণ সংক্রান্ত অভিযোগ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ট্যুর অপারেটর এবং ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, কমপক্ষে ১২টি দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক দেশ উচ্চহারে আবেদনও প্রত্যাখ্যানও করছে। এ ছাড়াও একাধিক দেশ তাদের ভিসা  প্রক্রিয়া খুবই  ভেবে চিন্তে এগুচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে  বিভিন্ন শর্ত জুড়ে  দিচ্ছে। সম্পূর্ণ ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে ভিয়েতনাম, লাওস, মিসর, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান। 
মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধের তালিকায়এবং মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান তিনটি দেশই শ্রমবাজারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেতুলোতেও ভিসা দেওয়া বন্ধ। নিউইয়র্ক কনস্যুলেট ঘিরে জালিয়াতির অভিযোগ, জাল কাগজপত্র ও অভিবাসী  শ্রমিকদের  অসন্তোষজনিত ঘটনাগুলোর পর এসব দেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অভিবাসন সংক্রান্ত শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ১২৩ বাংলাদেশিসহ ১৯৮ জন বিদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া।
এদিকে বৃহস্পতিবার ১২৩ অভিবাসীকে মালয় সরকার সে দেশে প্রবেশ করতে না দিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন। কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কেএলআইএ) টার্মিনাল ১ ও ২-এ মালয়েশিয়ান বর্ডার কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রোটেকশন এজেন্সি তাদের দেশটিতে প্রবেশ করতে দেয়নি।
মালয়েশিায় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা সংস্থার মহাপরিচালক দাতুক সেরি মোহাম্মদ শুহাইলি মোহাম্মদ জেইন বলেন, যাদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে তাদের ‘নট টু ল্যান্ড’ পদ্ধতির অধীনে বহিষ্কার করা হবে।
মালয় মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার, টার্মিনাল-১ থেকে ১২৮ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ১২৩ জন বাংলাদেশি রয়েছে।
শুহাইলি মোহাম্মদ জেইন বলেন, মালয়েশিয়াকে অবৈধ  প্রবেশের ট্রানজিট হাব হতে বাধা দেওয়ার জন্য এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
একসময় বাংলাদেশিদের জন্য সম্ভাবনাময় পূর্ব ইউরোপীয় দেশ হিসেবে বিবেচিত রোমানিয়া ও ক্রোয়েশিয়াও এখন ভিসা দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এসব দেশের অভিযোগ, বাংলাদেশি অভিবাসীরা আসার পরপরই সেগুলো ছেড়ে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে চলে যান। থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মতো জনপ্রিয় পর্যটন  দেশ হলেও সেখানেও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সেসব দেশে ভিসা পতে সময় লাগতো সর্বোচ্চ কয়েক সপ্তাহ এখন মাসের পর মাস অতিবাহিত হলেও সেখানে ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, এসব দেশে ভিসা আবেদনকারীদের বড় একটা অংশ প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশিদের তিন শতাধিক ভিসা আবেদন  প্রত্যাখ্যান করেছে। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উইং সুত্র জানিয়েছে, ভিয়েতনাম, লাওস ও ইন্দোনেশিয়াসহ সংশ্লিষ্ট  দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চলছে। এটি আমাদের সর্বোচ্চ  অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। যদিও এসব দেশ নিরাপত্তা ও নিয়মনীতিতে কঠোরতা অবলম্বন করছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইন্দোনেশিয়ার ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ সুবিধা ২০২১ সালের কোভিড মহামারির পর থেকেই স্থগিত  যা নতুন কোনো ইস্যু নয়। তবে ভিয়েতনামসহ  আরও কয়েকটি দেশের ভিসা পরিষেবা পুনরায় চালুর জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জনকণ্ঠকে বলেন, ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের বর্তমানে যে সকল সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা দীর্ঘমেয়াদি নয়।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট খাতে জড়িতদের স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে এ সকল সমস্যার সমাধান যোগ্য।
সিনিয়র এ বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার অবস্থান থেকে যে সকল দেশে ভিসা বন্ধ রয়েছে সে সকল দেশের প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এ সকল সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে রাষ্ট্রদূত বা সেখানের মিশনগুলোর লোকবল বাড়ানোর মাধ্যমে প্রবাসীদের সমস্যার বাস্তব চিত্রগুলো তুলে আনতে পারলে  এসব সমস্যা হবে না।
সরকারও তার অবস্থান থেকে প্রয়োজনে জনবল বাড়িয়ে প্রবাসীদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে পারলে এসব সমস্যা হবে না।
তিনি আরও বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ও যাদের পাঠাচ্ছে তাদের সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে কাজের ক্ষেত্র তৈরি নিশ্চিত করে প্রত্যেক দেশের চাহিদা অনুযায়ী লোকবল পাঠালে সমস্যাগুলোর পরিমাণ কমে আসবে। এ সকল বিষয় সমাধান করতে না পারলে বর্তমানে যে অবস্থানে বাংলাদেশ রয়েছে সে অবস্থান আরও অবনতির দিকে যাবে। 
 অবশ্য পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ইতোমধ্যে ঘর গোছানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে গণমাধ্যকর্মীদের নিশ্চিত করেছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশি ভিসা প্রাপ্তিদের আবেদনপত্রে অসংখ্য’ ‘ফেইক বা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা একটি বড় সমস্যা।’
তিনি বলেন, ভারতের ভিসা বন্ধ এবং অন্য অনেক দেশেও বন্ধ, এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নিতে পারে কিনা জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের ঘর গোছাতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেলস এজেন্সি। আপনি যা  তৈরি করতে পারবেন সেটাই আমি বিক্রি করতে পারব। আপনি যদি মিথ্যা তথ্য দেন, ভুল পাসপোর্ট দেন ২০ বছর আগে এটা সমস্যা ছিল না।
তৌহিদ হোসেন বলেন, যে কোনো মুহূর্তে একটা পাসপোর্ট একজনের পাঁচটা পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে-এ রকম উদাহরণও আছে। সেগুলো এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে।
উপদেষ্টা বলেন, কাজেই মিথ্যা তথ্য একটা প্রধান সমস্যা আমাদের। এটা এখনো আগের মতো চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু এটা সহজে ধরা পড়ে যায়। এ কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ঘর গোছাতে হবে। এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম যেন না হয় সেটা দেখতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে আমরা এটা ঠিক করে নিয়ে আসতে পারব।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বোটঅব) জানিয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে বহির্গামী পর্যটন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ এবং কর্পোরেট ভ্রমণ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। 
 বোটঅব সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান বলেন,‘ নির্বাচন পর্যন্ত এ অবস্থা চলমান থাকলে ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ  হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত ১১ মাসে কর্পোরেট বহির্গামী ভ্রমণ স্বাভাবিক মাত্রার ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। ট্যুর অপারেটররা এর জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও কঠোর ভিসা নীতিকে দায়ী করেছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ জালালউদ্দিন শিকদার বলেন,‘গণতান্ত্রিক উত্তরণ ছাড়া ভিসা সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ কূটনৈতিক  প্রচেষ্টা বিশেষ কোনো ফল আনেনি।
এদিকে, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের ভ্রমণ চাহিদা বাড়লেও বিমান টিকিটের দামে ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি ভ্রমণকারীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ  তৈরি করেছে।

প্যানেল

×