ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

আন্দোলনের সূচনা হয়  শিবগঞ্জ থেকে

জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা 

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৫ জুলাই ২০২৫

আন্দোলনের সূচনা হয়  শিবগঞ্জ থেকে

.

জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। এটি একটি জাতির সম্মিলিত স্লোগান, যার মধ্য দিয়ে ফিরে আসে হারানো স্বাধীনতা। এ গণঅভ্যুত্থান ছিল বঞ্চিত, নিপীড়িত ও শোষিত ছাত্র-জনতার এক গৌরবময় বিপ্লব, যা ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের অনিবার্য ভূমি নির্মাণ করেছে। সে সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আহ্বানে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। দুঃশাসনের শৃঙ্খল ভেঙে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের শপথ নেয় তারা। দেশের সব ছাত্রসংগঠনই এই আন্দোলনের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, যা ছিল স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে অভূতপূর্ব এক সংহতির নজির। ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের বিজয়ের ধারার সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এটি পরে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল, যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। 
যেভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আন্দোলনের সূচনা-
এ আন্দোলন জুলাইয়ের শুরুতে যখন শুরু হয়, তখন রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। জুলাই মাসের ১১ তারিখ সর্বপ্রথম জেলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা শিবগঞ্জে এ আন্দোলনের সূচনা হয়। সেদিন সকালে শিবগঞ্জের সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দের ব্যানারে ‘কোটা না মেধা’ স্লোগানে প্রথমে শিবগঞ্জ কলেজ প্রাঙ্গণে কর্মসূচির পালনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাধার মুখে পড়লে বিকেলে শিবগঞ্জ বাজারে অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী রতন মিশ্র এবং একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মিঞা মোহাম্মদ শীষ ও লিমনের নেতৃত্বে ২০-২৫  শিক্ষার্থী মিলে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে। এরপর একে একে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
উত্তাল শিবগঞ্জের স্মৃতিচারণ-
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা সমন্বয়ক আল বশরী সোহানের সঙ্গে কথা হলে সে সময়ের উত্তাল অগ্নিছড়া দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করেন তিনি। 
সোহান বলেন, জুলাইয়ের ১১ তারিখ শিবগঞ্জের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আন্দোলনের সূচনা হয়। সেদিনের গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর আন্দোলন পরবর্তীতে বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রথম দিনের স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হাসি-তামাশা করে কটাক্ষ করেন। কিন্তু তার কয়েকদিন পর ১৭ জুলাই বিকেল ৩টায় উপজেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের বৃহত্তর আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনের সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। 
সোহান জানান, সেদিন রাত থেকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাপে আমাদের আন্দোলনকারীরা অনেকে আত্মগোপনে চলে যায় এবং যারা বাসা বাড়িতে অবস্থান করত, তারা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাত। প্রতিদিন আন্দোলনকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে রাখত ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 
তিনি বলেন, আমাদের দমাতে না পেরে পরিবারের অভিভাবকদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হতো। সরাসরি চাপ কিংবা ভয় না দেখালেও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়াত। 
এরপর, ১৮ জুলাই সকালে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ব্যানারে একটি কর্মসূচি হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশি বাধার মুখে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেদিন কলেজের পাশর্^বর্তী চায়ের দোকান থেকে সোহেল রানা ও আবদুল আহাদ নামে দুই শিক্ষার্থীকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। শত শত শিক্ষার্থী চাঁপাইনবাবগঞ্জে উপস্থিত থাকলেও শহরের প্রতিটি অলিগলিতে পুলিশের টহলের মুখে একত্রিত হতে পারেনি তারা। দুপুর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলে আমি প্রফেসর পাড়ার গলির একটি বাসা থেকে ওয়াইফাই সংযোগ নিয়ে আমার কাছে থাকা প্রায় ৫০  শিক্ষার্থী মিলে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানের চেষ্টা করি এবং একত্রিত হয়ে পরদিন একটি বড় কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা করি। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে ওয়াইফাই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগে কিছুটা বিঘœ ঘটে। এমনকি সে সময় আমার মোবাইলের সিমটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতটার পরও আমাদের দমিয়ে রাখা যায়নি। 
তারপর, ২৪ ও ২৫ জুলাই কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গ্রাফিতি কর্মসূচি হাতে নিলেও আমরা প্রশাসনের কারণে পালন করতে পারিনি। তবে কে বা কারা রাতের আঁধারে জেলা শহরের স্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় দেওয়ালে দেওয়ালে কোটাবিরোধী গ্রাফিতি আঁকে। এ সময় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় আমরা কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারিনি। 
পুনরায় ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার পর ১ আগস্ট নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে জাতীয় সংগীত, রণসংগীত, বিদ্রোহী নৃত্য ও কবিতা আবৃতির মাধ্যমে ‘রিমেমরিং আওয়ার হিরোস’ নামে কর্মসূচি পালন করি। ২ আগস্ট একই স্থানে প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল কর্মসূচি পালন করি। ৩ আগস্ট সর্বাত্মক অহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা হয়। এদিন ৩ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে। 
এদিনের পর থেকে প্রশাসন অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করে, তবে রাতের বেলা জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে তাদের টহল কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। সেদিন রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে আন্দোলনকারীদের নিয়ে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়। 
৪ আগস্ট সকালে আওয়ামী লীগের শত বাধা উপেক্ষা করে শিবগঞ্জ বাজারে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী ও জনতার উপস্থিতি একটি মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। একইদিন বিকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বিশ^রোড মোড় ব্লক করে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পূর্ব ঘোষিত ৬ আগস্টের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে রাজধানীতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় থেকে একদফা কর্মসূচির ডাক আসে এবং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৫ আগস্ট এগিয়ে নিয়ে আসা হয়। আমারা ৫ আগস্টের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। 
৫ আগস্টের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির কারণে সকাল থেকে পুরো জেলার যানবাহন, ছোট বড় দোকানপাট, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সকালে শিবগঞ্জ বাজারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করি। এর মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতা শিবগঞ্জ আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় তারা শিবগঞ্জ থানায় প্রবেশের চেষ্টা করলে আমরা বাধা প্রদান করি। বিক্ষুব্ধ জনতাকে আমরা থানা থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হই। তখন থানার পুলিশ সদস্যরা থানার গেটে তালা দিয়ে অবস্থান করছিল। এরপর সেনাপ্রধানের বিকাল ৩টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি বিকাল ৪টায় পেছানো হয়। তখন আমরা অনুমান করি, শেখ হাসিনা দায়িত্ব হস্তান্তর করে দিয়েছে সেনাবাহিনীর কাছে।
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছাত্রশিবির
শহর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি এনায়েতুল্লাহ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে সাধারণ ছাত্র-জনতার সঙ্গে থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। জামায়াতে ইসলামীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার আমির হাফেজ গোলাম রাব্বানী ও তৎকালীন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ওমর ফারুকের সার্বিক সহযোগিতায় সকল জনশক্তি নিজ নিজ অবস্থান থেকে নেতৃত্ব প্রদান করেন। পাশাপাশি খাবার, আহত ভাইদের চিকিৎসা, গ্রেপ্তারকৃত মানুষের সার্বিক খোঁজখবর নিতেন শিবির ও জামায়াতের নেতৃবৃন্দ। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে যেন শহরের বাইরে থেকে কেউ এসে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করতে না পারেন, সে বিষয়ে তিক্ষœ নজর রাখা হতো। বিশেষ করে শহরের শিবতলা, বটতলা ও শাহীবাগসহ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আক্রমণ আসতে পারে এমন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
আতঙ্কের মধ্যেও মাঠে ছিল ছাত্রদল
শিবগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সভাপতি ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জানিবুল ইসলাম জোসি জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক শাহজাহান মিঞার নিদের্শনায় ছাত্রদল-স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ লড়াই করে শেখ হাসিনাকে বিদায় করেছি। সে সময় সর্বোচ্চ জনশক্তি নিয়ে প্রতিটি মিছিল ও সমাবেশে ছাত্রদলের সরব উপস্থিতি ছিল। জুলাই বিপ্লবের আগে আমাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় একবার গ্রেপ্তার করা হয়। আগস্টের ২, ৩ ও ৪ তারিখে ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে। আমরা কেউ বাসায় ঘুমাতে পারিনি। প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কের মধ্যে থেকে আমরা আন্দোলন থেকে পিছপা হয়নি। 
মামলাতেও দমেনি আন্দোলন
জেলা সমন্বয়ক আবদুর রহিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ঢাকায় আন্দোলন শুরু হলে জেলা শহরে আমরা সর্বপ্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ১৬ জুলাই সকালে মহানন্দা সেতুসংলগ্ন এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করি। বিকালে শান্তি মোড় অবরোধ করি। ১৮ ও ১৯ জুলাই আমাদের ওপর পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি পায় এবং আমিসহ ১১২ জনের নামে একটি বিস্ফোরক মামলা দায়ের করে পুলিশ। এছাড়াও পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলন দমাতে ৭টি মামলায় ৪ শতাধিক ব্যক্তির নামে মামলা হয়। এ সময় অনেককেই পুলিশ আটক করে। এরপর ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও আমরা বিভিন্ন কৌশলে সংগঠিত হতে থাকি। আগস্টের ১ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে সফল অর্জন করি। তিনি জানান, এই আন্দোলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুজন ঢাকায় শহীদ হন। এদের মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলার ছত্রাজিতপুর ইউনিয়নের কমলাকান্তপুর এলাকার মতিউর রহমান ছিলেন রিক্সাচালক। অপরজন গোমস্তাপুর উপজেলার তারেক রহমান। যিনি পেশায় ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তারা দুজনই ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হন।

প্যানেল

×