
.
একবছর আগে যে আলু বাজারে দামি সবজি হিসেবে বিবেচিত হতো সেটি এখন ভোক্তার কাছে সহজলভ্য খাদ্যপণ্য। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকায় যা অন্যান্য সবজির তুলনায় সামান্য। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এই পণ্যটি এখন রপ্তানিতে জোর দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ফলে সদ্য সমাপ্ত বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ প্রায় চারগুণ বেশি আলু রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি বাড়ায় খুশি কৃষক, তারা ভালো দাম পাচ্ছেন। এবার উৎপাদন মৌসুম থেকে কৃষকরা অভিযোগ করে আসছিলেন, তারা আলুর ন্যায্যদাম পাচ্ছে না। কিন্তু রপ্তানি বাড়ায় এখন একটু একটু করে দাম বাড়তে শুরু করেছে।
জানা গেছে, যেকোনো কৃষিজাতপণ্যের ন্যায্যদাম নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে আলু, পেঁয়াজ, ধান এবং অন্যান্য সবজির ন্যায্যদাম বাজারে কার্যকর হলে কৃষকরা উৎপাদনমুখী হবেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এরই প্রতিফলন দেখা গেছে আলু এবং পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। গতবছর আলু, পেঁয়াজ এবং ডিমের দাম বেশি ছিল বাজারে। ফলে ভোক্তারা অস্বস্তিতে ছিলেন, কিন্তু এবার এসব পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় বিশেষ করে যেসব কৃষক আলু উৎপাদন করেছেন তারা কিছুটা লোকসান করেছেন। মূলত ভালো দামের আশায় এ বছর কৃষকরা উৎপাদন বাড়িয়েছেন। এ অবস্থায় আলু রপ্তানি বাড়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে কৃষক সমাজ ও এ খাতের উদ্যোক্তাগণ।
এর পাশাপাশি ওএমএস (খোলা বাজার বিক্রি) কার্যক্রম এবং সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারি সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে আলু বিক্রি করবে সরকার। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। এ প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর ১০ লাখ টন আলু বেশি আছে। অন্তত ৫ লাখ টন আলু ওএমএস ও টিসিবির ট্রাকসেলের মাধ্যমে সমন্বয় করা না গেলে এখাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। আশা করছি, সরকারিভাবে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হবে। তবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ওএমএসের মাধ্যমে আলু বিক্রির চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সম্প্রতি সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা কৃষি উপদেষ্টা বলেন, গতবার যে দামে আলু কিনেছেন, এবার কৃষক এখন আলুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি কৃষক যেন আলুর দাম পায়। তাই ওএমএসের মাধ্যমে আলু সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি। কৃষক যদি পণ্যের দাম না পায় পরবর্তীতে কিন্তু তারা এটি উৎপাদনের দিকে যাবে না। এজন্য চেষ্টা করতে হবে কৃষক যাতে ন্যায্য দামটা পায়। তিনি বলেন, গতবার যে পরিমাণ পেঁয়াজের দাম ছিল। এবার কিন্তু কৃষক অনেক বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করেছে। পেঁয়াজ উৎপাদন বেশি করায় এবার পেঁয়াজ আমদানি না করেও কিন্তু বাজারটা মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। এগুলো কিন্তু কৃষকেরই অবদান। কৃষি উপদেষ্টা আরও বলেন, একশ’টি মিনি কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন করার আমাদের পরিকল্পনা আছে। আগামী মৌসুমের আগেই হয়তো আমরা এটি কমপ্লিট করতে পারব। এরপর আস্তে আস্তে সংখ্যা আরও বাড়বে। এতে কৃষকরা সেখানে সবজিটা সংরক্ষণ করতে পারবে। তারা ন্যায্যমূল্যটা পাবে একই সঙ্গে আমরা ভোক্তারাও ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাব। তিনি বলেন, দেশ যারা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের মধ্যে কৃষকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমরা তাদের অবদানটা সেভাবে প্রকাশ করি না। এদিকে, কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে এখন বেশ কিছু ভালো জাতের আলুর চাষ হচ্ছে, যেগুলো রপ্তানি বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। এর মধ্যে সানসাইন, গ্র্যানোলা, ডায়মন্ড, ম্যাজেস্টিক, প্রাডা, সান্তানা, কুইন এ্যানি, কুম্বিকা, ডোনেটা ও বারি আলু-৬২ মতো উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন আলু রয়েছে এই তালিকায় যেগুলো নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। দেশের বাজারে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এখন আলুর দাম কম। ব্যবসায়ীরা জোর দিচ্ছেন রপ্তানির ওপর। ফলে, সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আলু রপ্তানি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বলছে গত অর্থবছরে মোট ৬২ হাজার ১৩৫ টন আলু রপ্তানি হয়েছে। ২০২২ অর্থবছরের পর এটি সবচেয়ে বেশি। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন সর্বশেষ মৌসুমে তারা প্রতি কেজি আলু কিনেছেন সাত থেকে ২০ টাকায়। এর আগের মৌসুমে যা ছিল প্রায় ৩০ টাকা। এবার মাঠ পর্যায়ে অনেক কৃষক প্রতি কেজি আলু ১১ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাক্কলিত গড় উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছিল ১৪ টাকা। আর উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো জেলায় চাষের খরচ বেশি। সেখানে উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ২০ টাকা।
বাংলাদেশে সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বরে আলু বপন করা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ফসল তোলা হয়। এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড পাঁচ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ১৫ শতাংশ বেশি। দেশে গত নভেম্বরে আলুর দাম কেজি প্রতি ৮০ টাকা হওয়ায় অনেক কৃষক আলু চাষ বাড়িয়ে দেন। যদিও সরকার এখনো গত মৌসুমে আলু উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেনি, তবে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন আশা করছে, মোট উৎপাদন এক কোটি ২০ লাখ টন হতে পারে। সংগঠনটির সাবেক সভাপতি মো. মোশারফ হোসেন জানান, আলুর ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে হলে রপ্তানি বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারেও যাতে ন্যায্যদাম কার্যকর হয় সে বিষয়টি জোর দেওয়া প্রয়োজন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ভালো দাম না পেলে কৃষকরা উৎপাদন কমিয়ে দিবেন, সেক্ষেত্রে ফের আলু আমদানির দিকে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
এজন্য রপ্তানিতে প্রণোদনা বাড়ানো এবং কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাহরাইনসহ বেশ কিছু দেশে আলু রপ্তানি হচ্ছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক তাওহীদুল ইসলাম বলেন, মূলত দেশে দাম কম থাকায় গত বছর আলু রপ্তানি বেড়েছে। সর্বশেষ অর্থবছরে তিনি ৩০ হাজার টন আলু রপ্তানি করেছেন। আর এর আগের অর্থবছরে করেছিলেন এক হাজার ৪০০ টন। রপ্তানিকাররা জানান, প্যাকেজিং ও স্বাস্থ্যবিধি মানদ-ের সমস্যাগুলোর কারণে কম্বোডিয়া, হংকং ও ফিলিপাইনের বাজারে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হর্টেক্স এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. রফিকুল আমিন বলেন, রপ্তানি বাড়ায় কৃষকরা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন। তারপরও অনেক কৃষকের প্রচুর লোকসান হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে বেশি আলু রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়াতে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আলু রপ্তানি হচ্ছে। তবে এবার নেপালে আলু রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর দিয়ে নেপালে এ পর্যন্ত ১০৫ টন আলু রপ্তানি হয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে বাংলাদেশি আলুর কদর বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্যানেল